খাগড়াছড়িতে সচেতন নাগরিক সমাজের সাংবাদিক সম্মেলন: বাবুছড়ায় বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন বন্ধের দাবি

0

সিএইচটিনিউজ.কম
Press conference,khagrachariখাগড়াছড়ি: বাবুছড়ায় বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন বন্ধ করে অবিলম্বে বিজিবি সদস্যদের প্রত্যাহার এবং জেলা প্রশাসনের অবৈধ জমি অধিগ্রহণ বাতিল করে পাহাড়িদের নিজ নিজ জমি ফিরিয়ে দেয়া সহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছে খাগড়াছড়ির সচেতন নাগরিক সমাজ।

দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের নামে জমি বেদখল, নিরীহ পাহাড়ি গ্রামবাসীদের উপর হামলা, বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, মিথ্যা মামলা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে আজ ৮ জুলাই মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১১টায়  খাগড়াছড়ি শহরের মহাজন পাড়াস্থ টঙ রেস্টুরেন্ট এন্ড কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে সচেতন নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ এসব দাবি জানান।

সাংবাদিক সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন খাগড়াছড়ির বিশিষ্ট মুরুব্বী ও সমাজসেবক কিরণ মারমা।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, গত ৫ জুলাই ২০১৪ খাগড়াছড়ি সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল বাবুছড়া সরেজমিন পরিদর্শন করে জানতে পেরেছে, ১৪ মে রাতের অন্ধকারে বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যতœ মোহন কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়ায় পাহাড়িদের জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এরপর গত ১০ জুন বিকেল ৪টার দিকে গ্রামের কয়েকজন নারী তাদের জমিতে কলা গাছের চারা রোপন করতে গেলে বিজিবি সদস্যরা বাধা দেয়। নারীরা এর প্রতিবাদ করলে বিজিবি সদস্যরা তাদেরকে বেধড়ক মারধর করে। পরে গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে বিজিবি, পুলিশ ও সেটলার বাঙালি শ্রমিকরা তাদের উপর রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, বন্দুকের বাট ও লাঠিসোটা দিয়ে আক্রমণ করে। এতে ১৮ জন গ্রামবাসী আহত হয়, যাদের বেশীর ভাগ নারী ও বয়স্ক মহিলা। গুরুতর আহত চার নারীকে খাগড়াছড়ি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। এদের মধ্যে ১জনের হাত ভেঙ্গেছে এবং অন্যান্যরা আহত ও জখম হয়েছেন।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, উক্ত ঘটনার পরদিন বিজিবি ১১১ জনের নাম উল্লেখ করে ১৫০ জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে দীঘিনালা থানায় মিথ্য মামলা দায়ের করে। এই মামলায় ৫১ নং দীঘিনালা মৌজার হেডম্যান প্রান্তর চাকমা, বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুগত প্রিয় চাকমা ও সাবেক চেয়ারম্যান পরিতোষ চাকমাসহ এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মুরুব্বী ও বৃদ্ধ পুরুষ-মহিলাকেও ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনকি মামলায় তিন মৃত ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে। পুলিশ এই বানোয়াট মিথ্যা মামলার সূত্র ধরে গুরুতর আহত ৪ নারীকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল থেকে ও অন্য ৬ জন বৃদ্ধকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে দুই জন নারী জামিন পেলেও অপ্সরী নামক একজন নাবালিকা সহ বাকিদেরকে এখনো জেলে আটক রাখা হয়েছে।

Press conference2, 8 July 2014, khagrachariহামলার শিকার গ্রামবাসীদের বরাত দিয়ে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বিজিবির সদস্যরা বন্দুকের বাট দিয়ে তাদেরকে এমন নির্দয়ভাবে মারধর করেছে যে, এতে তাদের বন্দুকের বাট পর্যন্ত ভেঙে যায়। হামলার পর গ্রামবাসীরা বিজিবির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। এক কথায় যারা অন্যায়ের প্রতিবাদকারী, যারা হামলার শিকার ও আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছিলেন, অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে তারা হয়ে গেলেন আসামী, অপরাধী, আর উদ্ভট ব্যাপার হলো যারা আসল হামলাকারী তারা হয়ে গেলেন সাধু সজ্জন, থেকে গেলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

লিখিত বক্তব্যে বাবুছড়ার বর্তমান অবস্থার বর্ণনা দিয়ে কিরণ মারমা বলেন, হামলা ও উচ্ছেদের পর ২১ পরিবারের ৮৪ জন বর্তমানে বাবুছড়া হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্কুলের দুইটি কক্ষে গাদাগাদি করে অবস্থান করায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনেকে এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই ৮৪ জনের মধ্যে রয়েছে ৪ জন কলেজ পড়–য়া ছাত্রী, ৯ জন হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী ও ৭ জন প্রাইমারী লেভেলের ছাত্রছাত্রী। তাদের সবার পড়াশুনা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। বিজিবির বাধার কারণে গ্রামবাসীরা নিজ বাড়িতে যেতে পারছে না। হামলার পর থেকে তাদেরকে নিজ নিজ বাড়িতে যেতে দেয়া হচ্ছে না।

তিনি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার কথা তুলে ধরে বলেন,  বিজিবি হামলার পর ২ নং বাঘাইছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্কুলটিও বিজিবি তাদের কাঁটা তারের সীমানার ভিতরে ঢুকিয়েছে। ফলে স্কুলের ১০৫ জন ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে গ্রামবাসীদের চাষবাস সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন চাষের ভরা মৌসুম। চাষাবাদ না হলে তাদের কিভাবে জীবন চলবে, তারা কোথায় যাবে, কবে তারা নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবে এমন এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদেরকে ফেলে দেয়া হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ এখন পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন বলা যায়।

এলাকাবাসী চরম আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, মামলার কারণে গ্রামের অনেকে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের খোঁজার অজুহাতে লোকজনের মনে ভয়ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজিবি ও আর্মিরা নিয়মিত গ্রামে গ্রামে হানা দিচ্ছে। ফলে অনেকের স্বাভাবিক জীবন যাপন ও চাষবাস বন্ধ হয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলো আশির দশকে বাবুছড়া আর্মি ক্যাম্প স্থাপন ও বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে একবার উচ্ছেদ হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে শরণার্থী জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পার্বত্য চুক্তির পর সরকারের ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তির আওতায় তারা ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন। চুক্তি মোতাবেক সরকার তাদেরকে পুনর্বাসন ও নিজেদের জায়গা-জমি ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের নামে তাদেরকে আবারো নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর চেয়ে অমানবিক ব্যাপার আর কি হতে পারে?

লিখিত বক্তব্যে তিনি বিজিবি বৌদ্ধ মন্দিরের নামে রেকর্ডভুক্ত ৯৬০নং খতিয়ানে ১৫ শতাংশ জায়গা বেদখল করেছে বলে অভিযোগ করেন।

সাংবাদিক সম্মেলন থেকে ৫ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো:
১। বাবুছড়ায় বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন বন্ধ করে অবিলম্বে বিজিবি সদস্যদের প্রত্যাহার করতে হবে এবং জেলা প্রশাসনের অবৈধ জমি অধিগ্রহণ বাতিল করে পাহাড়িদের নিজ নিজ জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।
২। গত ১০ জুনের হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজিবির দেয়া মিথ্যা মামলা তুলে নিতে হবে; হামলার সাথে জড়িত বিজিবি, পুলিশ ও সেটলারদের গ্রেফতার করে আইন অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে; এবং হামলায় আহতদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩। বিজিবির দেয়া উক্ত মামলায় গ্রেফতারকৃতদেরকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
৪। গ্রামে গ্রামে সেনা ও বিজিবির টহলের নামে জনগণের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানো বন্ধ করতে হবে।
৫। উচ্ছেদকৃত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপুরণ প্রদান করতে হবে।

সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে আরো উপস্থিত চিলেন, খাগড়াছড়ির বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অনন্ত বিহারী খীসা, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর বোধিসত্ত্ব দেওয়ান, পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য বিনোদ বিহারী চাকমা, বিশিষ্ট মুরুব্বী অর্ধেন্দু শেখর চাকমা, হেডম্যান এসোসিয়েশনের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ সভাপতি ক্ষেত্র মোহন রোয়াজা, কার্বারী এসোসিয়েশনের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি ও সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রণিক ত্রিপুরা ও ঠিকাদার কল্যান সমিতির আহ্বায়ক ও সমাজ সেবক ধীমান খীসা, দীপায়ন চাকমা প্রমুখ।

এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কিরণ ত্রিপুরা, ধীমান খীসা ও অনন্ত বিহারী খীসা।
————–

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More