খাগড়াছড়ির কমলছড়ি ইউনিয়নে পাহাড়িদের উপর হামলার নেপথ্যে কারা?
বিশেষ প্রতিবেদক, সিএইচটিনিউজ.কম
খাগড়াছড়ি সদরের কমলছড়ি ইউনিয়নে কমলছড়ি গ্রামের গৃহবধু সবিতা চাকমা ধর্ষনের পর হত্যা ও শহীদুল ইসলাম নামে এক বাঙালি কিশোরের কথিত নিখোঁজের জের ধরে গত ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী পাহাড়িদের উপর পর পর দু’দফায় হামলার ঘটনা ঘটে। এ হামলায় ৫ জন পাহাড়ি গুরুতর আহত হন। এছাড়া পাহাড়িদের প্রতিরোধের মুখে কয়েকজন বাঙালি সেটলারও আহত হন। এ হামলার নেপথ্যে কি কারণ ও কারা জড়িত রয়েছে তা এখন দেখার বিষয়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারী কমলছড়ি গ্রামের গৃহবধু সবিতা চাকমা(৩০) ক্ষেতের কাজ করতে গিয়ে নিজবাড়ী থেকে কয়েক গজ দুরে খুন হন। এলাকাবাসীরা সবিতা চাকমার খুন হওয়ার ঘটনা ১২ টার দিকে খবর পেলে ও আইনি ঝামেলায় না যাওয়ার জন্য গ্রামের মুরুব্বীরা ঘটনাটা ধামা চাপা দিতে চেয়েছিলেন। পরে একজন থেকে অন্যজন এভাবে অনেকের কাছে খবরটা পৌছে গেলে তা আর গোপন না থেকে পুলিশের কাছে খবর পৌছায়। পুলিশ খবর পেয়ে অনেকটা বিবস্ত্র অবস্থায় সবিতা চাকমার লাশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে পোষ্টমর্টেমের জন্য খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে পাঠায়। এলাকাবাসীর ধারনা তাকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ বলছে তাকে গলা টিপে হত্যা করলেও ধর্ষণ করা হয়নি। এ ঘটনায় এলাকাবাসী কমলছড়ি বালু মহল থেকে বালু বহনকারী ট্রাক্টর চালক ও বাঙালি শ্রমিকদের সন্দেহ করে। কারণ ঘটনার দিন যেখানে সবিতা চাকমাকে হত্যা করা হয়েছে ঐ জায়গায় বালু বহনকারী ঐ ট্রাক্টরটি নষ্ট হওয়ায় দীর্ঘক্ষণ ধরে সেখান মেরামতের কাজ করা হয়েছিল বলে এলাকাবাসী জানায়।
সবিতা চাকমা হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও এর প্রতিবাদ স্বরূপ এলাকাবাসী কমলছড়ি সড়কে কয়েকদিন গাড়ী চলাচল বন্ধ রাখে। এরই প্রতিবাদে ২৫ ফেব্রুয়ারী পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ নামধারী একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন ট্রাক্টর চালক ও বাঙালি শ্রমিকদের সন্দেহ ও কমলছড়ি সড়কে যানচলাচল বন্ধের প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি শহরে শাপলা চত্বরে মানববন্ধন করে। মানবন্ধন থেকে অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। তাদের এই মানববন্ধনে খাগড়াছড়ি পৌর মেয়র রফিকুল ইসলামও বক্তব্য দেন। এই মানববন্ধন শেষে কমলছড়ি ইউনিয়নের ভূয়োছড়ি গুচ্ছগ্রাম থেকে অংশ নেওয়া বাঙালি ছেলেরা অবরোধ ভেঙে কমলছড়ি গ্রামের রাস্তায় দিয়ে ফেরার পথে কমলছড়ি গ্রামে পৌছলে “একটা দুইটা পাহাড়ি ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর”, “জালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও” ইত্যাদি উস্কানিমূলক শ্লোগান দিলে স্থানীয় কয়েকজন পাহাড়ি ছেলে এভাবে শ্লোগান না দিতে অনুরোধ করার জন্য গাড়ী থামায়। এতে বাঙালি ছেলেরা গ্রামের কিছুদূর কমলছড়ি শ্মশান এলাকায় গিয়ে পাহাড়িরা আমাদের উপর হামলা করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পাহাড়িদের গ্রামে হামলার চেষ্টা করলে এতে পাহাড়ি ও বাঙালি ছাত্র পরিষদের ছেলেদের সাথে মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয়। পরে বাঙালিরা পাশ্ববর্তী ভূয়োছড়ি ক্যাম্পে খবর দিলে সেখান থেকে একদল সেনা সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেনারা উপস্থিত হওয়ার পরপরই বাঙালি ছেলেরা পাহাড়িদের উপর চড়াও হয়ে হামলা শুরু করে। বাঙালিদের একটা গ্রুপ শ্মশান এলাকায় ও অপর একটি গ্রুপ সাজেক পাড়ার দিকে ঢুকে হামলা চালায়। এত ২ জন পাহাড়ি গুরুতর আহত হয়। সেনা সদস্যরা ঘটাস্থলে উপস্থিত থাকলেও হামলাকারীদের বাধা দেয়নি। বরং হামলা চালাতে বাঙালিদেরকে উৎসাহ দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ হামলার পর গ্রামে চলে যাওয়ার পথে বাঙালিরা ভূয়োছড়ি মুখে পাহাড়িদের গ্রামে হামলা করে এবং প্রিয়দর্শী চাকমার টমটম গাড়ি ও অপর একজনের একটি ধান কলের হোল্ডার ভেঙে দিয়ে যায়।
এদিকে, কমলছড়ির হামলার রেশ থামতে না থামতে আপার বেতছড়ি থেকে ছাগল আনতে গিয়ে ভূয়াছড়ি গুচ্ছগ্রামের শহর আলীর ছেলে শহীদুল ইসলাম(১৪) নামে এক ছেলে নিখোঁজ হয় বলে দাবী করে বাঙালিরা । নিখোঁজ শহীদুলকে খোঁজার নাম করে ২৬ ফেব্রুয়ারী সকালে সেটলার বাঙালিরা আপার বেতছড়ি চৈত্যার্দশ বৌদ্ধ বিহারসহ আশে-পাশের পাহাড়িদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। এতে পাহাড়িরাও প্রতিরোধ গড়ে তুললে বাঙলিরা এক পর্যায়ে পিছু হটে যায়। পরে বাঙালিরা দুপুর ১২টার দিকে ভুয়োছড়ির বর্ণাল মুখ এলাকায় এক পাহাড়ির বাড়ীতে হামলা করে এক পরিবারের ৩ জনকে কুপিয়ে গুরুত্বর আহত করে। এ হামলা চলাকালীনও ঘটনাস্থলে সেনা সদস্যরা উপস্থিত ছিল। কিন্তু সেদিনও তারা হামলাকারীদের না থামিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছে। এভাবে ২৫ ও ২৬ ফেব্রয়ারী পরপর দু’দিন পাহাড়িদের উপর হামলা চালায় বাঙালি সেটলাররা।
দু’দফা হামলার পর ১ মার্চ শনিবার আয়োজন করা হয় পাহাড়ি ও বাঙালি সেটলারদের নিয়ে শান্তি-সম্প্রীতির সমাবেশ। সমাবেশে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া ও ভুল বুঝাবুঝির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। সভায় ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তার জন্য আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান করা হয়। কিন্তু হামলাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন কথা সেই সভা থেকে বলা হয়নি।
এলাকাবাসীর প্রশ্ন সবিতা চাকমার খুন হওয়ার পর থেকে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবীতে কমলছড়ি গ্রামবাসীদের সড়ক অবরোধ চলাকালে বাঙালি ছাত্র পরিষদের ছেলেরা শাপলা চত্বরে মানববন্ধন শেষ করে অবরোধকৃত কমলছড়ি সড়কের দিকে শ্লোগান দিতে দিতে যাওয়ার সময় প্রশাসন কোথায় ছিল? আর তারা(বাঙালিরা) কমলছড়ি গ্রামে ঢুকে কেন পাহাড়িদের বিরুদ্ধে উস্কানিমুলক শ্লোগান দিলো? যারা উস্কানিমূলক শ্লোগান দিয়ে পাহাড়িদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপই বা কি?
কমলছড়ি এলাকার অনেক পাহাড়ি মুরুব্বী নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্তব্য করেন সবিতা চাকমার হত্যার ঘটনা ধামা চাপা দেওয়ার জন্য কমলছড়িতে আর একটি শহীদুল ইসলাম নিখোঁজ নাটক সাজানো হয়েছে। যেমনটি হয়েছিল মাটিরাঙ্গার তাইন্দং-এর কামাল আপহরণ নাটক ও কিছুদিন আগে গত ৩১ জানুয়ারী খাগড়াছড়ি জিরো মাইল অপরাজিতা বৌদ্ধ বিহার এলাকা থেকে মোঃ আবু তাহের অপহরণের সাজানো নাটক। প্রশাসন এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হলেও মূল পরিকল্পনাকারীরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যার কারণে পাহাড়িদের উপর এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটছে।
প্রশাসন যদি একটু চেষ্টা করে তাহলে এ হামলার নেপথ্যে কারা জড়িত রয়েছে তা বের করতে পারবে বলে মনে করেন এলাকাবাসী ও খাগড়াছড়ির সচেতন মহল।