খাগড়াছড়ির কমলছড়ি ও বেতছড়িতে সেটলার হামলায় ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ

0

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটিনিউজ.কম
খাগড়াছড়ির কমলছড়ি ও বেতছড়িতে গত ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারী পাহাড়ি গ্রামে বাঙালি সেটলাররা হামলা চালায়। এ সময় তারা পাহাড়িদের বাড়িঘরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, জিনিসপত্র ভাংচুর, লুটপাট ও একটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালায়।  এতে  কমপক্ষে ৫ জন পাহাড়ি গুরুতর আহত হয়।  এ ঘটনার পর হামলার প্রত্যক্ষদর্শী, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সাথে কথা বলে তাদের দেয়া তথ্য অনুসারে উক্ত হামলায় ক্ষয়-ক্ষতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে তুলে ধরা হলো:

বেতছড়ির বড়নালে সেটলারদের হামলায় আহত রমা দেবী চাকমা ও তার ছেলে বিপ্লব জ্যোতি চাকমা
বেতছড়ির বড়নালে সেটলারদের হামলায় আহত রমা দেবী চাকমা ও তার ছেলে বিপ্লব জ্যোতি চাকমা

বেতছড়ি গ্রামে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট:
২৬ ফেব্রুয়ারী সকালে সেটলাররা বেতছড়ি গ্রামে হামলা চালায়। এ সময় যাদের ঘরবাড়িতে হামলা, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও আংশিক ভাংচুর করা হয় তারা হলেন-
১. লতিক চাকমা(৬০) পিতা: মৃত যত্নমনি চাকমা। তার বাড়ির বেড়া কেটে দেয়া হয় এবং টেফিন ক্যারিয়ার ১টি, নতুন সোয়াবিন তেল ২লিটার, ৩০০টাকা লুট করা হয়।
২. মিলন জ্যোতি চাকমা (৩২) পিত: মৃত রাঙ্গাচান চাকমা। তার বাড়ি থেকে কাপড়-চোপড় লুৎপাট, গ্লাস ও আলনা ভাংচুর করা হয়। ৩. লোকদর্শী চাকমা (৪৫) পিতা: মৃত দীপংকর চাকমা। তার বাড়ির বেড়া, চালের টিন ও পেঁপে গাছ কেটে দেওয়া হয়।
৪. বজেন্দ্র চাকম (৬০) পিতা: মৃত সৈবেন্দ্র চাকমা। তার  বাগানের বাশঁ কেটে দেওয়া হয়।
৫. প্রতি লাল চাকমা(৫০) পিতা: মৃত কালাচান চাকম। তার সোলার ও ব্যাটারি ভাংচুর করা হয়।
৬. মন্তু লাল চাকমা (৪৫) পিতা: মৃত বিমল চন্দ্র চাকমা। তার ঘরবাড়ি ভাংচুর ও ৫০হাজার টাকা লুট করা হয়।
৭. ধারস চন্দ্র চাকমা(৬০) পিতা: মৃত চিদাকাজি চাকমা। তার বাড়ি থেকে কাপড় চোপড় লুটপাট করা হয়।
৮. বিপ্লব চাকমা(৩০) পিত: ধারস চন্দ্র চাকমা। তার বাড়ির হাড়ি পাতিল ভাংচুর করা হয়।
৯. প্রীতি ময় চাকমা(৬০) পিত: তারক চন্দ্র চাকমা। ঘরের জিনিস ভাংচুর করা হয়।
১০. রামায়ন চাকমা(৩৫) পিতা: মৃত বিমল চন্দ্র চাকমা। তার ঘর-বাড়ি ভাংচুর ও কাপড় চোপড় লুটপাট করা হয়।
১১. রিংকু ময় চাকমা(২৭) পিতা: প্রতি লাল চাকমা। ঘরের বিভিন্ন জিনিস ভাংচুর করা হয়।
১২. যুদ্ধ রঞ্জন চাকমা(৩৫) পিতা: লতিক চাকম। তার ঘরের জিনিস পত্র ভাংচুর করা হয়।
১৩. বরুন কান্তি চাকমা(৪৫) পিতা: মৃত অমিয় কান্তি চাকমা। তার ঘরের জিনিস পত্র ভাংচুর করা হয়।
১৪. উদয়ন চাকমা(৩০) পিতা: মৃত শৈলেন্দ্র চাকমা। তার ঘরের জিনিস পত্র ভাংচুর করা হয়।
১৫. সুগত তালুকদার (৩৫) পিতা: মৃত কালাচান তালুকদার। তার ঘরের আলনা, পাতিলা ও জিনস পত্র ভাংচুর করা হয়।
১৬. প্রগতি চাকমা(৪৯) পিত: রঞ্জন্য চাকমা। তার ঘরে বসানো সোলার ও লাইট ভাংচুর করা হয়।

একইদিন সেটলাররা বেতছড়ি মুখ গ্রামে হামলার সময় গোবিষ্কো চাকমা, তুহিন চাকমা, অনুতোষ চাকমা, মন্তু লাল চাকমা ও সজিব চাকমা’র নদীতে থাকা পাম্প মেশিনগুলো ভাংচুর ও নষ্ট করে দেয়।

চৈত্যাদর্শ বৌদ্ধ বিহারে হামলা:

চৈত্যাদর্শ বৌদ্ধ বিহারে এভাবে জিনিসপত্র  ভাংচুর ও তছনছ করে দেয়া হয়
চৈত্যাদর্শ বৌদ্ধ বিহারে এভাবে জিনিসপত্র ভাংচুর ও তছনছ করে দেয়া হয়

এদিন (২৬ ফেব্রুয়ারী) বাঙালি সেটলাররা বেতছড়ি চৈত্যাদর্শ বৌদ্ধ বিহারেও হামলা চালায়। তারা বিহারে ইটপাটকেল নিক্ষেপ সহ বিহারে ঢুকে বুদ্ধমূর্তি সহ জিনিসপত্র ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। যেসব জিনিসপত্র ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়- ১. চার ফুট উচ্চতা পিতলের বুদ্ধমূর্তি ১টি এবং মাঝারি পিতলের বুদ্ধমূর্তি ৩টি ভাংচুর, ২. বিহার উন্নয়ন দান বক্স ১টি (১৬ বছর যাবত চলতি সঞ্চয় টাকা প্রায় দুই লক্ষ টাকা) লুটপাট, ৩. পুরুষ সমিতি দান বক্স ১টি (চলতি ৫বছর যাবত সঞ্চয় টাকা প্রায় এক লক্ষ টাকা লুটপাট, ৪. মহিলা সমিতি দান বক্স ১টি (চলতি ৫ বছর যাবত সঞ্চয় টাকা প্রায় ৯০ হাজার টাকা) লুটপাট, ৫. থাইল্যান্ডের পিন্ডু পাত্র ১টি ভাংচুর, ৬. উন্নত মানের মাইকের স্পিকার ১টি ভাংচুর, ৭. উন্নত মানের এমপ্লি ফায়ার ১টি ভাংচুর, ৮. মাইক ১টি ভাংচুর, ৯. মাইকের তার ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) গজ কেটে টুকরা করে দেয়, ১০. সৌর বিদ্যুৎ’ এর তার ৩০ (ত্রিশ) গজ কেটে টুকরো করে দেয়, ১১. এ্যানার্জি DC বাল্ব ৫টি ভাংচুর, ১২. মেলামাইনের প্লেট ৮০ টি ভাংচুর, ১৩. গ্ল্যাস ২ (দুই) ডজন ভাংচুর,  ১৪.কলসি ২টি ভাংচুর ও ১৫. ফুলের টপ ৪টি ভাংচুর করা হয়।

বিহারে হামলার পরও ক্ষান্ত না হয়ে সেটলাররা বিহারের আশেপাশে ঘর বাড়িতে হামলা চালায়। যাদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয় তারা হলেন-১. ত্রিদীপ চাকমা(৪০) পিতা: মৃত কিনামনি চাকমা’র ৮ হাজার টাকা দামের সাইকেল ২টি ও রাইস হোল্ডার ১টি ভাংচুর করে ২. শান্তিময় চাকমা(২৮) পিতা: গমমনি চাকমা’র সোলারের বাল্ব ভাংচুর, সোলারের তার ও ঘরের বেড়া কেটে  নষ্ট করে দেয়, ৩. অলঙ্গ মনি চাকমা(৩০) পিতা: মৃত রাঁঙা চান চাকমা’র রাইস হোল্ডার ১টি ভাংচুর করে।

উক্ত হামলায় ভুয়োছড়ি গ্রামের সেটলার ১. মো: আবুল (প্রাক্তন মেম্বার) ২.শাইদুর রহমান ৩. মো: আয়নাল (লাকরি ব্যবসায়ি) ও ৪.মো: ইউসুফ (লাকরি ব্যবসায়ি) সহ ১৫০-২০০ জন সেটলার সম্পৃক্ত ছিলেন।

এ হামলার পর সেটলাররা বেতছড়ির বড়নালে পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। এতে আহত হয় রমা দেবী চাকমা(৬০), তার ছেলে বিপ্লব জ্যোতি চাকমা ও ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী মামনি চাকমা। তারা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।  দক্ষিণ ভুয়াছড়ি গ্রামের ১.চাঁন মিয়া (৪৫) ২. কাদের (৩৫) ৩. ইশহাক ৪. রফিক ৫. মনির ৬. আনোয়ার ও ৭.শামসু(আনসার সদস্য) সহ ১৫-২০ জন সেটলার তাদের উপর নির্মমভাবে হামলা চালায়।

এর আগে ২৫ ফেব্রুয়ারী বাঙালি সেটলাররা কমলছড়ি গ্রামে পাহাড়িদের উপর হামলার পর  চলে যাওয়া সময় ভুয়াছড়ি মুখ চাকমা গ্রামে রাস্তার পাশে চার্জে থাকা প্রিয় দর্শী চাকমার টমটম গাড়ি ও পলাশ চাকমার বাড়ি ভাংচুর করে। তারা পলাশ চাকমার বাড়ির হাড়ি-পাতিল ভেঙে দেয়। এছাড়া সেটলাররা শংকর চাকমার একটি ধান কলের হোল্ডারও ভাংচুর করে। এদিন সেটলারদের হামলায় গুরুতর আহত হয় কমলছড়ি মুখ গ্রামের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পান্ডক চাকমা(৩২) ও আনন্দ লাল চাকমা(৪৫)।

উল্লেখ্য, ১৫ ফেব্রুয়ারী কমলছড়ি গ্রামে সবিতা চাকমা (৩০) নামে এক গৃহবধুকে বাঙালিরা সেটলার ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা করে। এ ঘটনায় বালু বহনকারী ট্রাক চালক মো: নিজাম ও তার সহযোগীরা জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করে সবিতা চাকমার স্বামী দেব রতন চাকমা খাগড়াছড়ি সদর থানায় ও আদালতে পৃথক মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের জড়িত করার প্রতিবাদে ও ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করে ২৫ ফেব্রুয়ারী বাঙালি ছাত্র পরিষদ নামধারী একটি উগ্রসাম্প্রদায়িক সংগঠনের ব্যানারে সেটলাররা খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বরে মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করে। খাগড়াছড়ি পৌর মেয়র রফিকুল আলম উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য দিয়ে সেটলারদের উস্কে দিলে তারা মানববন্ধন শেষে ভুয়োছড়িতে ফেরার পথে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে দিতে কমলছড়ি গ্রামের দিকে যায় এবং এক পর্যায়ে পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। এ হামলার পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারী গরু চরাতে যাওয়া এক কিশোরকে খুঁজতে গিয়ে সেটলাররা একইভাবে বেতছড়ি গ্রামেও হামলা চালায়।  উভয় হামলায় সেনাবাহিনী সহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সকল সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও হামলাকারীদের সেটলারদের বাধা না দিয়ে তাদের সহযোগিতা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More