পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক মিছিল-সমাবেশে সেনা হামলা বাড়ছে
বিশেষ প্রতিনিধি : পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, কর্মসূচি নিয়ে পাহাড়ি জনগণের গণতান্ত্রিক মিছিল-মিটিঙ-সমাবেশে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ, বাধা দান ও হামলার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিককালে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের মিছিল-সমাবেশের উপর সংঘটিত হামলার ঘটনায় এমনই চিত্র দেখা গেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর এমন হস্তক্ষেপ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে জটিল করতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সিভিল প্রশাসনই গণতান্ত্রিক কর্মসূচি অর্থাৎ মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ ইত্যাদি দেখভাল করে থাকে। দেশের সমতল অঞ্চলে এমনটাই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় তার উল্টোটাই ঘটে থাকে। এখানে সেনাবাহিনীই যেন সব। তাদের কর্তৃত্বই এখানকার সিভিল প্রশাসনকে এক প্রকার অচল করে রেখেছে। ফলে পুলিশের বদলে সেনাবাহিনীই মিছিল-মিটিঙ, সভা-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। তারা মিছিল-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণের নামে হামলা, ধরপাকড় চালায়। এটা করতে গিয়ে সেনাবাহিনীকেও জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়াসহ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আর এতেই সৃষ্টি হয় নানা সমস্যার।
নব্বই সালে দেশটি স্বৈরাচার মুক্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো অপারেশন উত্তরণের নামে সেনাশাসন বলবৎ রাখা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পরও সেনা শাসন বাতিল করা হয়নি। উপরন্তু ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক এই অঞ্চলের উপর জারি করা হয় দমনমূলক ১১ নির্দেশনা। এই নির্দেশনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসনকে এক প্রকার বৈধতা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই সেনাবাহিনী এই অঞ্চলের জনগণের উপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। বেড়ে যায় গণতান্ত্রিক মিছিল সমাবেশের উপর সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও হামলা। এছাড়া অন্যায় ধরপাকড়, রাত-বিরাতে ঘরবাড়িতে তল্লাশি-হয়রানি এখন যেন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এখানে সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক গণতান্ত্রিক মিছিল-সমাবেশে হামলা ও বাধাদানের কিছু ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো:
গত ১১ এপ্রিল ২০১৭ খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি ও মাটিরাংগায় পাহাড়িদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি উপলক্ষে সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটির আয়োজিত র্যালিতে সেনাবাহিনী বাধা প্রদান করে। মানিকছড়িতে বাধাদানকালে র্যালিতে অংশ নেয়া জনতা প্রতিবাদ জানালে সেনাবাহিনী তাদের উপর লাঠিচার্জ করে। এতে একজন আহত হয়।
অপরদিকে মাটিরাংগায় ক্যাপ্টেন তানজিমের নেতৃত্বে ২০ থেকে ৩০ জনের সেনাবাহিনীর একটি দল বৈসাবি র্যালিতে আগত জনতাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এ সময় তারা র্যালি ও সমাবেশ করতে বাধা দেয়। শোভাযাত্রায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণকারী গণতান্ত্রিক যুবফোরামের দুই সদস্য শুভ চাকমা ও শান্তি বিকাশ চাকমাকে সেনাদলটি আটক করার চেষ্টা চালায়। এ সময় র্যালিতে অংশগ্রহণকারী সাধারণ জনতা এই অন্যায় আটকের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে তাদেরকে সেনাদলের কবল থেকে মুক্ত করে।
৮ মে ২০১৭ খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে রমেল চাকমা হত্যাকারী নান্যাচর জোনের সেনা কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিতে অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণ গণমানববন্ধন কর্মসূচিতে মানিকছড়ি ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা হামলা চালায়। এতে নারী-পুরুষসহ কমপক্ষে ১৮ জন আহত হন।
একইদিন একই দাবিতে রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়ায় আয়োজিত গণমানববন্ধন কর্মসূচিও সেনাবাহিনী ভণ্ডুল করে দেয়। এ সময় ইউপিডিএফ সংগঠক পুলক চাকমাকে সেনাবাহিনী আটক করে।
২০ মে ২০১৭ খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়িতে পিসিপি’র ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন আটক নেতা-কর্মীদের মুাক্তর দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে সেনাবাহিনী দু’দফায় হামলা ও গণগ্রেফতার চালিয়ে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র ও ৭০ বছরের বৃদ্ধসহ ৮ জনকে আটক করা হয়। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাতে ৭ জনকে জোন থেকে ছেড়ে দেওয়া হলেও শিমুল চাকমা নামে একজনকে লক্ষীছড়ি থানায় হস্তান্তরের পর খাগড়াছড়ি জেলে প্রেরণ করা হয়।
একই দিন উক্ত দাবিতে জেলার পানছড়িতে পিসিপি’র আয়োজিত সমাবেশে সেনা সদস্যরা বাধা দেয়ার চেষ্টা চালায়। সমাবেশ শেষে ফেরার পথে পানছড়ি সাব-জোনে সমাবেশে যোগ দিতে আসা ছাত্র ছাত্রীদের আটকিয়ে হয়রানি করা হয়।
২২ মে ২০১৭ রাঙামাটির নান্যাচরে “ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যথাযথ সংরক্ষণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অত্যাচারীদের শাস্তির দাবিতে এবং ‘থলচাপ তপোবন অরণ্য ভাবনা কুঠিরে সেনা কর্তৃক দরজা ভাংচুর, জুতা পায়ে প্রবেশ, বুদ্ধমূর্তির কাপড় খুলে ফেলা ও বুদ্ধাসনের সরঞ্জাম তছনছ করে দেয়ার’ প্রতিবাদে ত্রিশরণ কল্যাণ পরিষদ ও থলচাপ তপোবন অরণ্য ভাবনা কুঠির পরিচালনা কমিটির আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ কর্মসূচিতে সেনাবাহিনী হামলা চালায়। এতে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত ও পিসিপি’র নান্যাচর থানা শাখার সভাপতি জয়ন্ত চাকমাসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
গত ৪ জুন ২০১৭ দীঘিনালায় লংগদু হামলার প্রতিবাদে পিসিপি, যুব ফোরাম ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আয়োজিত মিছিল-সমাবেশে সেনাবাহিনী হামলা চালায়। এতে পিসিপি’র দীঘিনালা শাখার সভাপতি নীতিময় চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক জীবন চাকমাকে আটক করা হয়।
সর্বশেষ গত ৭ জুন খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আয়োজিত শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিজিবি-পুলিশ লাঠিসোটাসহকারে নারীদের উপর বর্বর হামলা চালায়। এ সময় নারীদের বেপরোয়াভাবে লাঠিপেটা করা হয়। এতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কর্মী-সমর্থকসহ ২১ জনকে আটক করা হয়। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে আটককৃতদের মধ্যে থেকে ১৩ জনকে ছেড়ে দিয়ে বাকী ৮ জনকে থানায় আটকে রাখা হয়। এই ৮ জন থেকে বৃহস্পতিবার (৮ জুন) খাগড়াছড়ি আদালত থেকে ৫ জন জামিনে মুক্তি পান, বাকী ৩ জনকে জেলে পাঠানো হয়।
এছাড়া গত বছর (২০১৬) ২০ মে দীঘিনালার বানছড়া উচ্চ বিদালয় মাঠে আয়োজিত পিসিপি’র ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী বাধা দিয়ে অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করে দেয়। ২ নভেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভরস্থ ইউপিডিএফ কার্যালয়ে পিসিপি নেতা বিপুল চাকমার মুক্তির দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সহ:সভাপতি বিনয়ন চাকমা ও সাংগঠনিক সম্পাদক অনিল চাকমাকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনী।
মূলত ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১১ নির্দেশনা জারির পর থেকে গণতান্ত্রিক মিছিল-সমাবেশ-মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচিতে সেনাবাহিনী সরাসরি হামলা ও বাধা দিতে শুরু করে।
ওই বছর ১৫ মার্চ দীঘিনালায় বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়ন প্রত্যাহারের দাবিতে এলাকাবাসীর শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচিতে সেনাবাহিনী হামলা চালায়। এরপর ৪ এপ্রিল খাগড়াছড়ি সদরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে পিসিপি’র আয়োজিত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দেয়া হয়। এদিন আটক করা হয় পিসিপি নেতা রতন স্মৃতি চাকমাকে। এরপরে ৫ এপ্রিল গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের উদ্যোগে খাগড়াছড়ি শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তা অভিযান কর্মসূচিতে বাধা প্রদান, ১২ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটির আয়োজিত বৈসাবি শোভাযাত্রায় হামলা চালিয়ে ভণ্ডুল করে দেয়া হয়, এতে বেশ কয়েকজন আহত হয় এবং খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের ছাত্র এল্টন চাকমাকে আটক করা হয়, ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত ফিলিস্তিনি সংহতি দিবসে খাগড়াছড়ি সদরে আট গণসংগঠনের আয়োজিত শান্তিপূর্ণ মিছিলে সেনাবাহিনী হামলা চালায়। এতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরূপা চাকমা ও খাগড়াছড়ি জেলা দপ্তর সম্পাদক(বর্তমানে সভাপতি) দ্বিতীয়া চাকমাকে পুলিশ আটক করে।
এরপর থেকে বর্তমান পর্যন্ত সেনাবাহিনী কর্তৃক গণতান্ত্রিক মিছিল-সমাবেশে হামলা, বাধাদানের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
সংবিধান সম্মত গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর সেনাবাহিনীর এহেন হস্তক্ষেপে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সচেতন মহল গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এই ধরণের জোর-জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে। এ ধরণের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সম্প্রতি দীঘিনালা ও স্বনির্ভরে সেনা-বিজিবি হামলার উপর দু’টি ভিডিও ক্লিপ নীচে দেওয়া হলো:
———————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।