পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানী আগ্রাসনের ৭০ বছরে খাগড়াছড়িতে তিন সংগঠনের আলোচনা সভা

0

খাগড়াছড়ি : পাকিস্তান বেলুচ রেজিমেন্ট কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে আগ্রাসনের ৭০ বছরে খাগড়াছড়িতে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডবিস্নউএফ) ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ) খাগড়াছড়ি জেলা শাখা৷ আজ সোমবার (২০ আগস্ট ২০১৭) বিকাল পৌঁনে চার টায় খাগড়াছড়ি জেলা সদর ঠিকাদার কল্যান সমিতি হল রুমে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়৷

আলোচনা সভায় এইচডব্লিউএফ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি দ্বিতীয়া চাকমার সঞ্চালনায় ও পিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি তপন চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা করেন ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় সদস্য নতুন কুমার চাকমা ও সংগঠক মিঠুন চাকমা, পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটি সভাপতি বিনয়ন চাকমা প্রমূখ৷

Khaalochonasova,20.08.17

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ১৯৪৭ সালে দি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম ও অমুসলিম বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান ভারত বিভক্ত হয়েছিল। সে অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ অমুসলিম হিসেবে অধ্যষিত হিসেবে অঞ্চলটি ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত অথবা অলাদা একটি রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হাওয়ার কথা ছিল৷ সে অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হবার সময় নিজেরাই পছন্দের দেশ হিসেবে অমুসলিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিল। পার্বত্য নেতারা ১৫ আগস্ট রাতে রাঙামাটিতে ভারতের পতাকা ও বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলন করে। তবে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত পার্বত্যবাসী জানতে পারেনি তাদের ভাগ্য কোন দেশের সাথে বাঁধা পড়েছে।

সবার আশা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতেরই অংশ হবে অথবা স্বাধীন রাজ্য হিসেবে বজায় থাকবে, যার থাকবে যেকোনো দেশে যোগদানের স্বাধীনতা এবং প্রয়োজনে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার অধিকারও তার থাকবে।

কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী সীমানা চিহ্নিতকরণের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থেকে যায়৷ পার্বত্য জনগণের তৎকালীন নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্ত না মানার ঘোষণা দেয় এবং সে অনুযায়ি পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। তবে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট কর্ণফুলি ও সাংগু নদী দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে বান্দরবান ও রাঙামাটিতে উত্তোলিত পতাকা নামিয়ে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ পাকিস্তানী আগ্রাসনের শিকার হয়৷ এই দিনটিকে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর পাকিস্তান বাহিনীর আগ্রাসন দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে।

বক্তারা আরো বলেন, ৭১ সালে পাকিস্তান উপনিবেশিক শাসন থেকে বাংলাদেশের জনগণ মুক্ত হয়েছে। কিন্তু আজ ৪৬ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে শাসন করে যাচ্ছে এই দেশের সরকার। ১৯৭২ সালে প্রণিত সংবিধানে জাতিসত্তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি, বরং তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিব ক্ষমতা ও জাতিদম্ভ দেখিয়ে পার্বত্য জনগণের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না মেনে পাহাড়ি জাতি ও জনগণকে ‘বাঙালি হয়ে যেতে’ হুমকি ধামকি দিয়েছে। ২০১১ সালে প্রণিত সংবিধানেও জাতি হিসেবে বাঙালি ব্যতীত অন্য কোনো জাতি বা জাতিসত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। এভাবে দেশের অন্য জাতিসমূহকে কার্যত অস্বীকারই করা হয়েছে।

উপরন্তু এই রাষ্ট্র এখনো পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীকে বৃহৎ জাতির ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃহৎ জাতির স্বার্থ রক্ষা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজই জাতিগতভাবে নিরপেক্ষ এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি করে যাচ্ছে। পাকিস্তানী শাসক এবং বেলুচ রেজিমেন্টের সাথে এই দেশের সেনাবাহিনীর কোনো পার্থক্যই যেন দেখা যায় না।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী যেভাবে নিপীড়ন চালাতো ঠিক সেভাবে এখনো প্রতিনিয়ত পাহাড়িদের উপর দমন-পীড়ন, শোষণ নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন, গুম, হত্যা, রাতের আঁধারে বাড়ি ঘরে তল্লাশি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে ঘটে যাচ্ছে। আগ্রাসনকারী ঔপনিবেশিক শক্তির বৈশিষ্ট্যই এতে প্রতিফলিত হয়।

বক্তারা বলেন, এসব পরিস্থিতিসহ নানান পরিস্থিতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য চর্চা ও লালন পালন করতে পারছে না। পার্বত্য জুম্ম জনগণকে তাদের বাপ দাদার ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

আলোচনা সভা থেকে বক্তাগণ সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃহৎ  বাঙালি জাতির পাহাড়াদার তথা স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে ব্যবহার না করতে শাসকদের প্রতি আহবান জানান  ও ‘জোর যার মুল্লুক তার’ মাতসন্যায় নীতি পরিহার করে অন্য জাতিসমূহকে দেশের মুক্তি সংগ্রামের নীতি অনুযায়ী অধিকার প্রদান করতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন।

সভায় বক্তারা, পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনরত সকল বীর সহযোদ্ধাদের স্মরণ করেন এবং এদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বীরত্বের সাথে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রাম জোরদার করার জন্য নতুন প্রজন্মের ছাত্র-যুব-নারী সমাজসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান৷
————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More