পিসিপি’র কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে ১২দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনা গৃহীত

0

PCP1রাঙামাটি : বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর ২০তম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে আলুটিলায় পর্যটন কমপ্লেক্স, লংগুদু’র রাবেতা আল ইসলাম ও রামপাল বিদুকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধসহ ১২ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে। গত ২৪ – ২৫ আগস্ট ২০১৬ রাঙামাটিতে দু’দিন ব্যাপী এই প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

“সকল বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই এগিয়ে নিন, অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেকে দায়িত্বশীল, দক্ষ ও যোগ্য সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রত্যয়ী হোন” এই স্লোগান উর্ধ্বে তুলে ধরে বিপুল উসাহ উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক বাছাইকৃত অর্ধ শতাধিক প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক অংশগ্রহণ করেন।

সম্মেলনস্থলে স্থাপিত গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান ও উদ্ধৃতি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন ছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং লড়াই সংগ্রামে প্রেরণাসঞ্চারকারী। কেন্দ্রীয় ও শাখা প্রতিনিধিদের স্ব স্ব এলাকার সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ এবং কেন্দ্রের পেশকৃত রিপোর্টের ওপর গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনায় সম্মেলনের অধিবেশন ছিল সজীব আর প্রাণবন্ত। প্রতিনিধি সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সভাপতি কর্তৃক পেশকৃত ১২ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে।

আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। তারপরেই  রাঙামাটি জেলা শাখার সদস্য কংচাই মারমা, খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সদস্য জেসীম চাকমা, কাউখালী উপজেলা শাখার সভাপতি ক্যাচিং মারমা, মাটিরাঙ্গা উপজেলা কমিটির সভাপতি দীপঙ্কর ত্রিপুরা ও পানছড়ি কলেজ শাখার সভাপতিসহ বিভিন্ন সময়ে সেনা-পুলিশের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত ১৭ জন কারামুক্ত সহযোদ্ধাকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়।PCP2

এবারের পিসিপি প্রতিনিধি সম্মেলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এতে বর্তমান পরিস্থিতি ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে একটি ‘রাজনৈতিক প্রস্তাব’ গৃহীত হয়েছে। এতে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদানের সরকারি পদক্ষেপের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করে সতর্কতার সাথে সাধুবাদ দেয়া হয়েছে এবং পিসিপি’র তার ঘোষিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্তের সমাপ্তি টানলো। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা পিসিপির দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের ফল বলে প্রতিনিধি সম্মেলন মনে করে।

প্রতিনিধি সম্মেলনে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে রামপাল বিদ্যু কেন্দ্র ২৩ নভেম্বরের মধ্যে বন্ধের বেঁধে দেয়া সময় সীমাকে যৌক্তিক হিসেবে উল্লেখ করে “তেল গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যু-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি”র ঘোষিত ২৬ নভেম্বরের ঢাকা মহাসমাবেশ-এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রস্তাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, খাগড়াছড়ির আলুটিলায় ইকো ট্যুরিজম প্রকল্পের ৬৪০একর জমি অধিগ্রহণের নামে পাহাড়ি উচ্ছেদ ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বাতিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৬ খসড়া বাতিল ও বিতর্কিত সংস্থা লংগুদুর ‘রাবেতা আল ইসলামের’ কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
১২দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে “অপারেশন উত্তোরণ” বাতিলপূর্বক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের “১১দফা নির্দেশনা” প্রত্যাহার করে রাজনৈতিক কারণে আটক ইউপিডিএফসহ অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দান।

পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি সিমন চাকমার সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক বিপুল চাকমার পরিচালনায় প্রতিনিধি সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, ইউপিডিএফ রাংগামাটি জেলা সমন্বয়ক শান্তিদেব চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রিনা চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের দপ্তর সম্পাদক লালন চাকমা এবং পিসিপির কেন্দ্রীয় ও অন্যান্য শাখার নেতৃবৃন্দ।

ইউপিডিএফ নেতা শান্তিদেব চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন করা হচ্ছে। সরকারের নির্দেশে সেনা নিপীড়ন অব্যাহতভাবে চলছে। সেনা তল্লাশি, ধরপাকড়, নির্যাতনে জনগণ অতিষ্ঠ। ইউডিএফ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীদের ওপর মিথ্যা মামলা রজু করা হয়েছে। ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমা ,ক্য হ্লা চিং মারমাসহ অনেক নেতাকর্মীদের জেলে অন্তরীণ করে রেখেছে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানপন্থী জঙ্গী সাম্প্রদায়িক কতিপয় সেনা কর্মকর্তা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে তপর রয়েছে। ফলে সেনা মদদপুষ্ঠ সেটলারদের দৌড়াত্ম বেড়েই চলেছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, খাগড়াছড়িতে সেনা-সেটলাররা সাম্প্রদায়িক ঘটনা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে, যা ইতিমধ্যে তাদের কার্যকলাপে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

পিসিপি সভাপতি সিমন চাকমা বলেন, নব্বই দশকের গৌরবোজ¦ল সংগ্রামের উত্তরসূরী হিসেবে পিসিপি আপোষহীন লড়াইয়ের ধারা অব্যাহত রেখে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সংগঠিত করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পাশাপাশি ছাত্র সমাজকে ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। তিনি সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ছাত্র সমাজকে অধিকার আদায়ের সোচ্চার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রিনা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সেটলার দ্বারা পাহাড়ি নারীরা প্রতিনিয়ত কোন না কোন জায়গায় ধর্ষণ হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নারী সমাজ পথে ঘাটে এমকি ঘরেও নিরাপত্তাহীন। তিনি সেনা সৃষ্ট পর্যটন সম্প্রসারণের সমালোচনা করে বলেন, পর্যটনের নামে একদিকে ভূমি বেদখল আর অন্যদিকে এসব পর্যটন স্পটে প্রায় সময় সেনা-সেটলার দ্বারা নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ পর্যটন স্পট সেনা-সেটলারদের ইভ টিজিং-এর সুবিধাজনক ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের দপ্তর সম্পাদক লালন চাকমা বলেন, পাহাড়ে ছাত্র-যুব সমাজকে ধ্বংসের জন্য মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন খাগড়াছড়ি আলুটিলায় ইকো ট্যুরিজমের নামে ৬৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণের সমালোচনা করে বলেন, এটি বাস্তবায়ন হলে পাহাড়িরা বিশেষত ত্রিপুরা জাতিসত্তার জনগণকে আরেক বার ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে হবে। তিনি জনগণকে অন্যায় ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

এখানে উল্লেখ্য যে, রাঙ্গামাটি সদরের হ্রদ পরিবেষ্টিত এক নিভৃত পল্লীকে বেছে নেয়া হয়েছিল পিসিপি প্রতিনিধি সম্মেলনের ভেন্যু হিসেবে। বিভিন্ন এলাকা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি-পর্যবেক্ষকগণ নির্দেশনা মত নৌকা যোগে আগের দিন রাতে সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত হন। ইতিপূর্বে পর পর দু’বার (চট্টগ্রাম ২০১৫ ও দীঘিনালা ২০১৬) পিসিপি’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ায় এবার পিসিপি ছিল বেশ সতর্ক। যে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিনিধি সম্মেলন সফল করতে কর্মীবাহিনী ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীগণ পরিত্যক্ত বাড়ি ও রান্নাঘরে রাত যাপনের বন্দোবস্ত করে। সম্মেলনে প্রতিনিধিদের জন্য রান্না ও প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদনের লক্ষ্যে নিয়োজিত ছিল ইউপিডিএফ ও পিসিপি’র বাছাইকৃত কর্মীদের একটি দল। সম্মেলনের শেষ দিন বেলা থাকতেই প্রতিনিধি পর্যবেক্ষকগণ নির্দেশনা মত এলাকা ছেড়ে যায়। প্রতিনিধি সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারায় পিসিপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং কর্মীবাহিনী বেশ উজ্জীবিত হয়েছে।
—————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More