বাবুছড়া ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের জন্য ক্রয়কৃত জায়গার সংস্কার কাজে বাধা প্রদানের আসল উদ্দেশ্য কি তবে জুম্মদের সংখ্যালঘুতর ও প্রান্তিকীকরণ করা?
।। নিঝুম চাকমা ।।
দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া ইউনিয়নে উৎসাহী শিক্ষানুরাগীদের উদ্যোগে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাবুছড়া ফ্রেন্ডশীপ স্কুল। এলাকার অনেকেই এই স্কুলের উন্নয়নে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের দক্ষিণ পাশে শুক্রজয় চাকমা’র পুত্র মহারাজা চাকমা’র ২০ শতক জায়গায় অস্থায়ীভাবে উক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়টির জন্য বেড়া ঘেরা টিনশেড ঘর তৈরী করা হয়। ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৫ জন এবং ২০১৫ সালে ৭৯ জন। এই বছর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১২৫ জনে।
তিন বছরের মধ্যে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে বোঝা যায় এলাকায় মানসম্মত শিক্ষা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণ এই স্কুলটিকে অন্যতম ভালো স্কুল হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন। এইসব দিক খেয়াল রেখে স্কুল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাবুছড়া ইউনিয়ন সদরের পাশে বাবুছড়া মৌজা হেডম্যান সত্যেন্দ্রিয় চাকমার সহায়তায় ৩০ শতক পরিমাণ জায়গা স্কুলের নামে ক্রয় করে। জায়গাটির বাজার মূল্য ১৫/২০ লাখ টাকা হলেও স্কুল নির্মাণ করা হবে এই বিবেচনায় জায়গার মালিক নামমাত্র মূল্যে জায়গাটি স্কুলের জন্য প্রদান করেন। ক্রয়সূত্রে জায়গাটি পাওয়ার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ জায়গাটির উন্নয়নমূলক সংস্কার কাজ করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সংস্কার কাজ চলার সময় মাস দুয়েক আগে বাবুছড়া ক্যাম্পের সেনাবাহিনী জায়গাটিতে কোন ধরনের সংস্কার করার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। উল্লেখ্য, সেনাবাহিনীর এ ধরনের উন্নয়নমূলক কাজে বাধা প্রদান বেআইনী, কারণ একমাত্র আদালতই কোন কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারী করার ক্ষমতা রাখে।
ফ্রেন্ডশীপ স্কুল পরিচালনা কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মাস খানেক আগেই ইউনিয়ন পরিষদের কাজের আওতায় প্রায় ৩৩ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক ৪ দিন ধরে স্কুলের জন্য কেনা জায়গায় মাটি কাটে। মাটি কাটার ৪র্থ দিনে বাবুছড়া আর্মি ক্যাম্পের মেজর ইমরান নামে এক সেনা অফিসার তার দলবলসহ শ্রমিকদের উক্ত জায়গা থেকে চলে যেতে বলে। মেজর ইমরান তাদের জানিয়ে দেন যে, স্কুলের জায়গাটি তাদের কাজে লাগবে। তবে কী কাজে লাগবে তা তিনি জানাননি। উক্ত পরিচালনাক মিটির সদস্য আরো জানান, তারপর থেকে স্কুলের জায়গায় আর কোন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, ফ্রেন্ডশীপ স্কুলের জন্য ক্রয়কৃত উক্ত জায়গাটি বর্তমান বাবুছড়া সেনাক্যাম্প ও অবৈধভাবে বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়নের জন্য দখলীকৃত জায়গা থেকে প্রায় আধা থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তবে বাবুছড়া সদর থেকে বাবুছড়া সেনাক্যাম্প ও বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়নের জন্য নির্মাণাধীন হেডকোয়ার্টারে ঢোকার পথে জায়গাটি পথের নাগালের মধ্যেই পড়ে।
বাবুছড়া ফ্রেন্ডশীপ স্কুলের জন্য কেনা জায়গাটির পাশে অবস্থিত একটি বাড়ির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহকর্ত্রী জানান, সেনাবাহিনীরা উক্ত জায়গার পাশে পান ক্ষেত বা পান বরজ করতে পর্যন্ত দেয়নি। ‘সন্ত্রাসী বাহিনী ওঁত পেতে থেকে সেনাবাহিনীর উপর হামলা করবে’ এই কথা বলে তারা পান ক্ষেত করতে দেয়নি বলে তিনি জানান।
এদিকে এলাকার অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ করা হবে না এই শর্তে সিএইচটি নিউজ ডটকমকে জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল র্যাংকের এক কর্মকর্তা উক্ত জায়গা ও তার আশেপাশের এলাকা মাপজোক করে নিয়ে গেছেন। তিনি আরো জানান, তিনি জেনেছেন বাবুছড়া ইউনিয়নকে আগামী বেশ কয়েক বছরের মধ্যে উপজেলায় রূপান্তর করা হবে। উপজেলা ঘোষণা করা হলে উপজেলা প্রশাসনের জন্য অনেক জায়গা জমির প্রয়োজন হবে।
তিনি মনে করেন দীঘিনালা উপজেলাকে ভাগ করে বাবুছড়া উপজেলা করার আসল উদ্দেশ্য হলো এই এলাকার জুম্মদের সংখ্যাগত শক্তিকে বিভাজন করা এবং দীঘিনালা উপজেলায় বাঙালি সেটলারদের সংখ্যাগরিষ্টে রূপান্তরিত করা। কারণ বাবুছড়া ইউনিয়ন যদি দীঘিনালা উপজেলা থেকে চলে যায় তখন সেটলাররা সেখানে আপনাআপনি সংখ্যাগরিষ্ট হয়ে যাবে এবং তাদের পক্ষে নির্বাচনে দীঘিনালা উপজেলাকে কব্জা করা সহজ হবে। অপরদিকে বাবুছড়া উপজেলা করা হলে সেখানে সরকারী প্রশাসনের অফিস আদালত বসবে এবং তার সাথে আগমণ ঘটবে বাঙালিদের। আর এভাবে তারা ক্রমে বাবুছড়া উপজেলায়ও সংখ্যাগরিষ্টে পরিণত হবে। এই সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে বাবুছড়া ফ্রেন্ডশীপ স্কুলের উন্নয়ন কার্যক্রম বাধা দেয়া হচ্ছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
কাজেই এটা অত্যন্ত পরিস্কার যে, সেনাবাহিনী এক সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ফ্রেন্ডশীপ স্কুলের জন্য নির্ধারণকৃত জায়গায় উন্নয়নমূলক সংস্কার কাজ করতে বাধা দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এযাবৎকালের ইতিহাসে এটাই দেখা গেছে যে, সরকার তথা প্রশাসনের যে কোন ধরনের প্রশাসনিক উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে জুম্ম জনগণকে ক্রমাগতভাবে এলাকা ছাড়া হতে হয়েছে এবং পরিবর্তে উক্ত ‘উন্নত সদর’ এলাকায় সেটলার বাঙালি বা বহিরাগত বাঙালির বসতি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোন শহর বা প্রশাসনিক সদর এলাকাতেই স্থানীয় পাহাড়ি বা জুম্ম জনগণ সংখ্যাগতভাবে সব সময় সংখ্যালঘুই হয়ে রয়েছে।
এখন বাবুছড়া ইউনিয়নকে উপজেলায় রূপান্তর করার আগে সুবিধাজনক ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো সরকার ও সেনা প্রশাসন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে আগামীতে উক্ত এলাকায় বহিরাগত বাঙালি ও সেটলারদের জন্য বসতি স্থাপন ও তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে সচেতন জনগণের মধ্যে সন্দেহ ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছে। #
—————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।