কালের কণ্ঠে আর্মিদের সুর ও ক্রসফায়ারে রাঙামাটির পুলিশ সুপার

0

।।  মন্তব্য প্রতিবেদন।।
লোকে বলে সত্য একটাই, কিন্তু মিথ্যাকে নানা রঙ বদলাতে হয়। দৈনিক কালের কণ্ঠের আজকের (২৩ এপ্রিল) সংখ্যায় ‘ইউপিডিএফের সশস্ত্র এক সদস্যের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়কে অশান্ত করার চেষ্টা’ শিরোনামে রাঙামাটি থেকে পাঠানো কাজী হাফিজের প্রতিবেদনে এই কথার সত্যতা আবার প্রমাণিত হলো। প্রথমে বলে রাখি তার এই প্রতিবেদনটি জঘন্য মিথ্যাচারে পূর্ণ এবং এতে নানিয়াচর জোনের সেনাদের সুরই প্রতিধ্বনিত হয়েছে মাত্র। সেটার ব্যাখ্যা করতে হলে উক্ত প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃতি দেয়া আবশ্যক। তাই পাঠক, অনুগ্রহপূর্বক ধৈর্য্য ধারণ করুন।

প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ৫ এপ্রিল রমেল চাকমা ওরফে সুপেন নামের এক সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে আটক করে যৌথ বাহিনী। সে ইউপিডিএফের একজন সদস্য।’

Commentaryপিসিপি নানিয়াচর শাখার সাধারণ সম্পাদক ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছাত্রনেতা রমেল চাকমাকে ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসী’ হিসেবে আবিস্কার করে কাজী হাফিজ রাঙামাটির বাঘা বাঘা সাংবাদিককে যে টেক্কা দিলেন, এজন্য তার কী প্রাপ্য হতে পারে তা আমরা ভেবে কুলকিনারা পাই না। তবে তার এই প্রতিবেদনের কারণে কালের কণ্ঠের সুনামে যে বারোটা বেজেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর প্রতিবেদকের নিজের ব্যক্তিগত ক্রেডিবিলিটি বা ভাবমূর্তি যে ধূলোয় মিশে গেছে তার কথা নাই বা বলা হলো। অবশ্য সামান্য অর্থের বিনিময়ে যারা নিজেদের গণিকাবালার মতো বিকিয়ে দিতে কসুর করে না, তারা কি আর ক্রেডিবিলিটির ধার ধারে?

প্রতিবেদকের দ্বিতীয় আবিস্কার হলো: রমেল চাকমা ইউপিডিএফের সদস্য এবং তিনি অতীতের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। কিন্তু কাজী সাহেব ছাত্রনেতা রমেল চাকমা ও ‘সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের’ মধ্যে ঘটকালি করলেও তাদের ‘বিয়ে’ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ রমেল অতীতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন বা থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, এমন কোন দৃষ্টান্ত বা প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। তার কথা এমন, যেন কেউ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত থাকলেই তাকে আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া সেনা হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলা যুক্তিসঙ্গত বা জাস্টিফাইড। আবোল তাবোল বকে যে সত্যকে চাপা দেয়া যায় না সে কথা কাজী সাহেবকে ও নানিয়াচর জোনের সেনাকর্তাদের বোঝাবে কে? তারা তো পাহাড়ে এভাবে ভেবেই অভ্যস্ত যে, বন্দুকের জোরে রাতকে দিন এবং দিনকে রাত করা যায়।logokalerkantho

প্রতিবেদকের ওরফে আর্মিদের নতুন একটা তথ্য হলো, টিএন্ডটি এলাকায় অভিযান চলাকালে রমেল পালানোর চেষ্টা করেন এবং সিএনজি চালিত একটি অটো রিক্সার সাথে তার ধাক্কা লাগলে তিনি আহত হন। ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠক, এই ভার্সনটি আগে শুনেছেন কি? ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হলে তো তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নেয়ার কথা, তাই নয় কি? কিন্তু তারা সেখানে না নিয়ে জোনে নিয়ে গেলেন কেন? জোন থেকেও আবার হাসপাতালে না, নিয়ে গেলেন থানায়। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে লাভ আছে কি?

তারপর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো রাঙামাটির পুলিশ সুপার সৈয়দ তারিকুল হাসানের উদ্ধৃতি নিয়ে। বক্ষ্যমান প্রতিবেদনে তার এক ধরনের উদ্ধৃতি, আর মানবকণ্ঠের প্রতিবেদনে অন্য ধরনের উদ্ধৃতির রহস্য কী তা জানার জন্যও বোধ হয় একটা তদন্ত কমিটি গঠন করার দাবি জানানো আবশ্যক হতে পারে। প্রথমে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত তার উদ্ধৃতি তুলে ধরা যাক:

‘রাঙামাটির পুলিশ সুপার সৈয়দ তারিকুল হাসান এ বিষয়ে বলেন, “ইউপিডিএফ কোনো নিবন্ধিত সংগঠন নয়। যেহেতু তাদের সদস্যদের তালিকাও আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা জেনেছি যে রমেল চাকমা ওই সংগঠনটির সশস্ত্র সদস্য ছিল।”’

এবার এর সাথে তুলনা করে মানবকণ্ঠে প্রকাশিত তার উদ্ধৃতি পড়ুন:

‘রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান মানবকণ্ঠকে বলেন, অপরাধীকে ধরা হলো ভালো কথা। কিন্তু তার জন্য তো আইন আছে। সে অনুযায়ী তার বিচার হবে। কিন্তু তাকে নির্যাতন করে পুলিশের কাছে আনা হলো। তার শারীরিক অবস্থা দেখে পুলিশ তাকে গ্রহণ করেনি। পরে সে মারা গেল। মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়েও টানাটানি। এখন দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে পুলিশের ওপর। মানুষ মরেছে অবরোধ হবে স্বাভাবিক। এখানে মারপিট করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা হলো। ফলে পরিবহন ধর্মঘট যোগ হয়েছে। এখন পুলিশকে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এসব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যা হয়েছে এখানে পুলিশের কোনো হাত নেই। যদি আমাদের দায়ী করা হয় তাহলে তদন্ত করে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। অন্যায়কে পুলিশ কখনো প্রশ্রয় দেবে না।’

আমরা উপরোক্ত দুই উদ্ধৃতি বিষয়ে বিশেষ কিছু মন্তব্য করতে চাই না, শুধু এটুকু বলতে চাই, পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসানের বলিষ্ট বক্তব্য কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন ও নানিয়াচর জোনের সেনাকর্তাদের বক্তব্য পুরোপুরি খারিজ করে দেয়। তিনি যেভাবে দৃঢ়তা দেখিয়ে সত্য উচ্চারণ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এমনকি পুলিশের বিরুদ্ধেও তিনি তদন্ত দাবি করেছেন। নিজের সংগঠন বা সংস্থার বিরুদ্ধে এমন দাবি কতজন লোকে করতে পারে?

কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক তার প্রতিবেদনে অভিযোগ করে বলেছেন, রমেল চাকমার ‘মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ রাঙামাটিকে অশান্ত করার নানা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ একজনের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর এক এক ব্যর্থ চেষ্টা। শুধু রাঙামাটি কেন সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ অশান্ত। বলতে গেলে বহু আগে থেকেই অশান্ত। কেন? কারণ প্রতিদিন পাহাড়িদের বাড়িঘরে অহেতুক সেনা তল্লাশী, ভয়ভীতি প্রদর্শন, নিরীহ লোকজনকে বিনা কারণে গ্রেফতার, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করা ইত্যাদি কারণে পাহাড়িদের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। আটকের পর সেনা হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনের ফলে আজ পর্যন্ত কতজন যে পঙ্গু বা প্রায় পঙ্গু হয়েছে তার হিসাব পাওয়া ভার। এমনকি বৈসাবি উৎসব পর্যন্ত ঠিকভাবে করতে দেয়া হয় না। সেনাবাহিনী একদিকে ঘোষণা দেয় বৈসাবি উৎসবের জন্য নিরাপত্তা দেয়া হবে, অন্যদিকে মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়িতে বৈসাবি র‌্যালি করতে বাধা দেয়া হয়। এসব কারণে পাহাড়ে আজ সর্বত্র ক্ষোভ আর অসন্তোষ।

মূলতঃ সেনাবাহিনীই পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ি। একটি রাজনৈতিক বিষয় বা সমস্যাকে তারা সামরিকভাবে সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে। জন্ডিসের জন্য হলদে হওয়া চোখকে তারা চোখের অপারেশনের মাধ্যমে সারাতে চাইছে। ফলে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হতে বাধ্য। অতীতেও তারা এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সমাধান করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা সবাই জানি এতে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে শত শত পাহাড়ি বাঙালির জীবন হানি হয়েছে, শত শত কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা শান্তি ও স্থিতিশীলতা নির্বাসিত হয়েছে।

আমরা আর অতীতের সেই ধরনের পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে চাই না। তাই সেনাবাহিনী যেভাবে অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। রাজনীতিকে তার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দিন। সেনাবাহিনী রাজনীতিতে নাক গলালে কী হয়, দেশে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয় তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরো বেশী জটিল ও সংকটাপন্ন হওয়ার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন। (সমাপ্ত)
—————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More