পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এদিন : লংগদু গণহত্যা

0

সিএইচটিনিউজ.কম

লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মৌন মিছিল ১৯৮৯। ফাইল ছবি
লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মৌন মিছিল ১৯৮৯। ফাইল ছবি

লংগদু গণহত্যা ১৯৮৯ :
১৯৮৯ সালের ৪ মে সংঘটিত হয় লংগদু গণহত্যা। এদিন রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে পরিকল্পিতভাবে হামলা করে এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, বৌদ্ধ মন্দির ও বুদ্ধ মুর্তি ধ্বংস করে। সেটলারদের এ হামলায় বহু পাহাড়ি হতাহত হয়।

এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়ে ‘৮৯ সালের ৯ মে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, প্রাক্তন সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তৎকালীন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান এবং রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন।

স্মারকলিপিতে তারা এ হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “উপজেলা সদরে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য, লংগদু ইউনিয়নপরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান  ও ৩নং লংগদু মৌজারহেডম্যান অনিল বিহারী চাকমা তার বাসভবনে হামলার শিকার হন। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচেগেলেও তার স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের অনেকে(যারা হেডম্যানের বাসভবনে আশ্রয় নিয়েছিল) এইনির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যাকারীরা দা, বল্লম ইত্যাদি সহ আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা, গুলি করে এইসব নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি। মৃতদেহগুলি বাড়ীতে ফেলে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। অনিল বিহারী চাকমা তার স্ত্রীর মৃতদেহ বাড়ী থেকে বের করে বাড়ীর পাশ্ববর্তী জঙ্গলে সারারাত পাহারা দিয়ে রাখেন। ভোরের দিকে থানায় খবর দিতে এসে পরে উদ্ধার করতে গেলে পরবর্তীতে মৃতদেহের কোন হদিস পাননি। পরিস্থিতির এমন ভয়াবহতায় মৃতদেহগুলি ধর্মীয় বিধিতে পর্যন্ত সৎকার করা সম্ভব হয়নি।”

এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে বিকাল ৪-৫ টা নাগাদ লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার তার অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার আড়াই ঘন্টা পর লংগদুতে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের উপর প্রতিশোধ মূলক হামলা শুরু হয়। এই প্রতিশোধমূলক হামলায় কম করে ৩৬ জন নারী-পুরুষ ও শিশু মারা যায়। তবে এর প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে রিপোর্টে বলা হয়। আর আব্দুর রশিদ সরকারের মৃত্যুর জন্য শান্তিবাহিনীকে দায়ী করা হলেও এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর কোন কারণ খুঁজে পায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ্যামনেস্টির ওই রিপোর্টে বলা হয়, “… কম করে ৬টি গ্রাম আক্রমণ করা হয়, পাহাড়িদের শত শত ঘরবাড়ি, অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির এবং খ্রিস্টানদের দু’টি গীর্জা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। যারা বেঁচে যায় তারা আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ে ও জঙ্গলে পালিয়ে যায় এবং তাদের একটা বিরাট অংশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।”

যে সময় এ গণহত্যা সংঘটিত হয় তখন ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসনামল। ফলে এ বর্বর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ সে সময়কার বাংলাদেশের কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। তবে পরবর্তীতে যখন ঘটনাটি প্রচার পায় তখন থেকেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়।

বর্বরতম এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। লোমহর্ষক এ গণহত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর জন্য ঢাকার রাজপথে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ১৯৮৯ সালের ২১শে মে মৌন মিছিল সহকারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ এ বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে।  হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৩০ মে’৮৯ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ঢাকায় মৌন বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

এ গণহত্যার আজ ২৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও কোন সরকারই এ হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবতা বিরোধী এসব হত্যাযজ্ঞের কি কোন বিচার হবে না?
—————–

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More