ঢাকায় পিসিপি’র সংবাদ সম্মেলন

পিসিপি’র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার প্রত্যাখ্যান ও ৮দফা দাবিসহ মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

0

ঢাকা রিপোর্টার॥ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক এক বিতর্কিত সার্কুলার জারি (১৯ নভেম্বর/১৭) ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান অস্থির পরিস্থিতিতে আজ সোমবার ২৭ নভেম্বর সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এক সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেছে। এতে পিসিপি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত সার্কুলারের স্ববিরোধী ও দুর্বল দিক সমালোচনা করে একে বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। সংবাদ সম্মেলনে ‘শিক্ষাঙ্গনে ফ্যাসিবাদী থাবা, রুখে দাঁড়াও ছাত্রসমাজ! এক হও গণতান্ত্রিক শক্তি! আহ্বান সম্বলিত ব্যানার টাঙানো ছিল। বিরাজমান পরিস্থিতিতে পিসিপি ৮দফা দাবিসহ ডিসেম্বর মাসব্যাপী সভা-সমাবেশ বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকে ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’ আর ‘পার্বত্য চুক্তি’ বিষয়ে জানতে চাইলে পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি বিনয়ন চাকমা তার যথাযথ উত্তর দেন। তিনি পর্তুগালসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে মাত্র হাজার পাঁচেক জনসংখ্যার জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন ভোগ করার নজীর এশিয়ায় রয়েছে বলে জানান।

‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’ লড়াই বিচ্ছিন্নতার দিকে ধাবিত হবে কিনা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে, তা পিসিপি সভাপতি নাকচ করে দেন। ইউপিডিএফ-এর ‘পার্বত্য চুক্তি’ প্রত্যাখ্যানের সাথে দক্ষিণপন্থী উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ দলগুলোর ‘চুক্তি’ বিরোধিতাকে এক করে একশ্রেণীর মিডিয়ার উদ্দেশ্য প্রণোদিত অপপ্রচার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে পিসিপি নেতা বলেন, এ দু’টি দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে পার্থক্য দিন-রাত্রির মতো। ‘পার্বত্য চুক্তি’ অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত ছিল বলেই ইউপিডিএফ তা প্রত্যাখ্যান করে, অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী উগ্র সাম্প্রদায়িক দলসমূহ ‘চুক্তি’তে উল্লেখিত ন্যুনতম অধিকারও দিতে চায় না।

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অনিল চাকমা, দপ্তর সম্পাদক রোনাল চাকমা ও অর্থ সম্পাদক সুনীল ত্রিপুরাসহ ঢাকাস্থ নেতৃবৃন্দ।

পিসিপি’র উত্থাপিত ৮দাবিসমূহ হলো : ১। অবিলম্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, বেসরকারী কলেজ শাখা-৬’এর জারিকৃত অবৈধ সার্কুলার (১৯ নভেম্বর/১৭) প্রত্যাহারপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সকল শিক্ষার্থীর সংবিধান স্বীকৃত অধিকার নিশ্চিত করা; ২। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দমনমূলক ‘১১দফা নির্দেশনা’ প্রত্যাহারপূর্বক সভা-সমাবেশের ওপর বিধি-নিষেধ তুলে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা; ৩। রাজনৈতিক কারণে আটক ইউপিডিএফভুক্ত সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীদের নিঃশর্তে মুক্তি দান; ৪। পিসিপি’র সভাপতি বিনয়ন চাকমা-সাধারণ সম্পদক অনিল চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি অংগ্য মারমা ও সাধারণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরাসহ ইউপিডিএফভুক্ত সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারপূর্বক অন্যায় ধরপাকড়, হুমকিমূলক সেনা টহল ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি বন্ধ করা;। ৫। এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমার খুনী নানিয়ারচর সেনা জোনের অধিনায়ক লে. কর্ণেল বাহালুল আলম ও মেজর তানভিরের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণপূর্বক এলাকায় সন্ত্রাসী লেলিয়ে উৎপাত সৃষ্টির ষড়যন্ত্র বন্ধ করা; ৬। পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা পরিষদ কর্তৃক ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ বাতিলপূর্বক যত দ্রুত সম্ভব উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দান; ৭। পাঠ্যসূচি থেকে সাম্প্রদায়িক অংশ বাদ দিয়ে যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা; ৮। বহুল বিতর্কিত ‘প্রাথমিক সমাপণী পরীক্ষা’ বাতিলপূর্বক শিশুদের মানসিক চাপ মুক্ত করে সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত করা।

সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত মাসব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে : সংগঠনের উপজেলা-কলেজ লেভেলের কমিটি কর্তৃক ডিসেম্বর মাসব্যাপী সভা-সমাবেশ; ৩ ডিসেম্বর শহীদ মং শে স্মরণে স্মরণসভা; ৪ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি জেলায় ছাত্র সমাবেশ; ৯ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে ছাত্র সমাবেশ; ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধে পূষ্পার্ঘ্য অর্পণ; ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে বিক্ষোভ-মিছিল সমাবেশ ও ২৭ ডিসেম্বর ঢাকায় সংহতি সমাবেশ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন।

সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত লিখিত বক্তব্যে পিসিপি’র সভাপতি বিনয়ন চাকমা বলেন,‘ পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের এক প্রত্যন্ত অবহেলিত অঞ্চল, এখানে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী সেনা মোতায়েন রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দমনমূলক ‘১১দফা নির্দেশনা’ জারির মাধ্যমে এখানে কার্যত সেনা শাসনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। সেনা মোতায়েনের পরিণতি কী হয়, তা জরুরি অবস্থার সময় ২০০৭ সালের ২০-২৩ আগস্টে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে সেনা ও ছাত্রদের মধ্যে যে সংঘর্ষ বাঁধে, তাতে শিক্ষকসহ ছাত্রসমাজের ওপর যে আক্রমণ চালানো হয়– তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে পুরো ব্যাপারটি অনুমান করতে অসুবিধে হবে না।

বিনয়ন চাকমা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়ত সেনা নজরদারি ও শাসনের মধ্যে রয়েছে। ১৯ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমাকে সেনা কর্তৃক হত্যা ও পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি আরো জানান স্থানীয় থানা উক্ত ঘটনায় মামলা নেয় নি, সাধারণ ডায়েরি করতে দেয় নি, কোর্টেও মামলা করা যায় নি। ঘটনার মূল হোতা স্থানীয় সেনা অধিনায়ক লে. কর্ণেল বাহালুল আলম বহাল তবিয়তে থেকে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশেও বাধা দিচ্ছেন বলে পিসিপি নেতা মন্তব্য করেন। তিনি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদিকা মন্টি চাকমাকে মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণের বাহালুল আলমের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

লিখিত বক্তব্যে পিসিপি নেতা আক্ষেপ প্রকাশ করে আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, লাইব্রেরী, বিজ্ঞানাগার, শিক্ষা উপকরণ ও সর্বোপরি মানসম্মত শিক্ষকের বড় সংকট। বিদ্যালয়গুলোতে শরীর চর্চা, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক ও সৃষ্টিশীল কর্মকা-ও নেই। এ সমস্ত দিকে দৃষ্টি না দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীনহীন একটি কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানের ব্যানারের শ্লোগান বিকৃত করে, তার ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সার্কুলার জারি করে শিক্ষার্থীদের কয়েদী বানাতে চাইছে। তিনি একে শিক্ষাঙ্গনে ফ্যাসিবাদী থাবা বিস্তারের অপচেষ্টা মন্তব্য করে ক্ষমতাসীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন।

—————————–

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More