ভূমিদস্যুতাই জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের কারণ

0

বদরুদ্দীন উমর, সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে নাহারপুঞ্জি-১ নামে একটি খাসী গ্রামে খাসী জনগণকে তাদের ভিটেমাটি ও পানের বাগান থেকে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে নাহার চা বাগানের ম্যানেজার পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ৩০ মে খাসীদের ওপর এক আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। এর আগেও সেখানে এ ধরনের আক্রমণ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই উপরোক্ত চা বাগান মালিকদের পক্ষ থেকে খাসীদের উচ্ছেদ করে জায়গাটির দখল নেওয়ার চেষ্টা চলে আসছে। এ বিষয়ের ওপর ১ জুন তারিখে ডেইলি স্টার পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, নাহার চা বাগানের ম্যানেজার পীযূষ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে প্রায় দুইশ’ লোক নাহারপুঞ্জি-১ নামক খাসীপুঞ্জির ওপর আক্রমণ করলে তারা খাসীদের পক্ষ থেকে বাধার সম্মুখীন হয়। সংঘর্ষের ফলে ২০ জন খাসী আহত হন, যাদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর।

Khisia human chainনাহারপুঞ্জি-১-এর সহকারী হেডম্যান বলেন, তারা যে জমির ওপর বসবাস করেন সেটা সরকারি খাস জমি। তার সঙ্গে চা চাগানের কোনো সম্পর্ক নেই। জেলা প্রশাসনের এই জমির ওপর তারা বাস করে আসছেন এবং এই জমি লিজ নিয়ে সরকারকে তারা খাজনা দিয়ে থাকেন। মৌলভীবাজারের ডেপুটি কমিশনার কামরুল হাসান বলেন, এটা সরকারের খাস জমি, তবে এ জমি প্রশাসনের, না বন বিভাগের_ সেটা তিনি জানেন না। এ জমির মালিক যে নাহার চা বাগান নয়, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও গায়ের জোরে এর মালিকানা দাবি করে চা বাগানটির পক্ষে তাদের ম্যানেজার পীযূষ ভট্টাচার্য খাসী বসতিটির ওপর আক্রমণ চালান। সংবাদপত্র রিপোর্টটি থেকে জানা যায় যে, আক্রমণকারীদের জমির ভাগ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েই এ কাজে প্রবৃত্ত করা হয়।

খাসীদের এই বসতিটিতে জমির পরিমাণ ২০০ একর। এ জমির ওপর বসবাস করে ৭৯টি খাসী পরিবার এবং এদের সংখ্যা হলো ৬৫০-এর মতো। এর ওপর তারা শুধু বসবাস করেন না, যে পান চাষের ওপর তাদের জীবিকা নির্ভরশীল সে পান বাগানও এই জমির ওপর অবস্থিত। কাজেই খাসীদের ওপর এই আক্রমণ শুধু তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ব্যাপার নয়, এর ফলে তাদের জীবিকার উপায়ও আর থাকবে না। খাসীরা ঐতিহ্যগতভাবে পান চাষের মাধ্যমেই নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

এই চা বাগান মালিকদের মতো ভূমিদস্যুরা আজ দেশের সর্বত্রই দুর্বল জনগোষ্ঠীর জমি ও ভিটেমাটি দখল করার এক মহোৎসবে মত্ত হয়েছে। এই মহোৎসব যারা করছে তাদের যে কোনো ধর্ম পরিচয় নির্দিষ্ট নেই, এটা শ্রীমঙ্গলে খাসীদের ওপর আক্রমণের এই ঘটনা থেকেই দেখা যাচ্ছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে চা বাগানের হিন্দু ম্যানেজার পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে। এই আক্রমণকে কেউ সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করছে না। কিন্তু এই একই আক্রমণ যদি কোনো মুসলমানের দ্বারা হিন্দু বসতির ওপর হতো, তাহলে একে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মহলে অনেক তোলপাড় শুরু হতো! আক্রমণের আসল কারণ আক্রমণকারীদের প্রকৃত পরিচয়ের পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় পরিচয় সামনে এলে এই ‘অসাম্প্রদায়িক’ লোকেরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাদের পবিত্র সংগ্রাম শুরু করে দিতেন! আজকের বাংলাদেশে ভূমিদস্যুতাই পরিণত হয়েছে লুণ্ঠনজীবী শাসকশ্রেণীর লোকদের ধনসম্পদ অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায়। এক হিসেবে বলা চলে সর্বপ্রধান উপায়। এ জন্য যেখানেই এরা কারও দুর্বল অবস্থান দেখে, সেখানেই মানুষের জমি ও ভিটেমাটি দখলের জন্য মরিয়া হয়ে দুর্বৃত্ত ও দস্যুগিরি করে। এ কারণে বাংলাদেশে এখন খুব ব্যাপকভাবে মুসলমান বাঙালিরাই মুসলমান গরিব ও দুর্বল বাঙালিদের ওপর ব্যাপকভাবে সর্বত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের নাকের ডগায় এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এসব ঘটনা ঘটায় এটা বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে রাতারাতি যেসব লোক হাজার হাজার কোটি টাকার ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছে, তারা অধিকাংশই ভূমিদস্যু, কোনো না কোনোভাবে ভূমিদস্যুতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, সাধারণভাবে ভূমিদস্যুতা ব্যাপকভাবে চলতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় এবং বিশেষত জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ এখন আগের যে কোনো সময় থেকে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তর বাংলার রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর ইত্যাদি অঞ্চলে সাঁওতাল এবং অন্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চলছে। এই আক্রমণ চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপরও। এই আক্রমণকারীদের কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় নেই। এদের কোনো দলগত পরিচয়ও নেই। এদের মধ্যে আছে হিন্দু-মুসলমান, আছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টির লোক। আছে এমন লোক যার কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় নেই। এরা সকলেই ভূমিদস্যু এবং জোরপূর্বক অন্যের জমি দখলের উদ্দেশ্যেই এরা দুর্বল গরিবদের ওপর নানা অজুহাতে অথবা কোনো অজুহাতের পরোয়া না করেই হামলা চালায়।

এই আক্রমণকারীদের প্রকৃত চরিত্র আড়াল করার উদ্দেশ্যে এদের বাঙালি জাতিগত চরিত্র আড়াল করে এদের ধর্মীয় চরিত্র, বিশেষত মুসলমান চরিত্র সামনে এনে আসল ব্যাপার ঘোলাটে করে জনগণের সামনে উপস্থিত করা হয়। ভূমিদস্যুতার ব্যাপকতা বৃদ্ধির সঙ্গে ধর্মীয়সহ সব সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে হিন্দুদের ওপর যে কোনো আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপক বৃদ্ধি নিয়ে এখানকার ‘অসাম্প্রদায়িক’ মহলে কিছু হৈচৈ হলেও এই আক্রমণ কমছে না। উপরন্তু শাসকশ্রেণী ও তাদের সরকারের চোখের সামনে এসব ঘটেই চলেছে। এর মূল কারণ এটা কোনো প্রকৃত সাম্প্রদায়িক আক্রমণ নয়। ধর্মের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এ হলো ডাকাতি করে ধনসম্পদ অর্জনের এক সহজ উপায়। কিন্তু ‘অসাম্প্রদায়িক’ যোদ্ধারা ডাকাতির বিষয়টিকে আড়াল করে আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীদের ধর্মীয় চরিত্র সামনে হাজির করার কারণে এই বিকৃত ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদে কোনো কাজ হচ্ছে না! তাদের কথিত ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বৃদ্ধিই পাচ্ছে! ভুয়ো কথা ও কাজের মাধ্যমে যে কিছু অর্জিত হতে পারে না এসবই হলো তার অভ্রান্ত প্রমাণ।
মুসলমান যেমন হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ভিটে জমিজমার ওপর চড়াও হচ্ছে, তেমনি হিন্দুও হিন্দুর ভিটে ও জমি দখল করছে একইভাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায় না। কারণ, ভূমিদস্যু হিসেবে ক্রিমিনালদের অপকর্ম নিয়ে হুলস্থূল করার ব্যাপার এখানে নেই। এটা ‘অসাম্প্রদায়িক’ ব্যক্তিদের রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্র বা সেবালয় নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা ঘটছে। কিন্তু হিন্দুদের ওপর আক্রমণ যত হচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি মাত্রায় আক্রমণ হচ্ছে সাঁওতাল, রাখাইন, ওঁরাও, খাসী, গারো ইত্যাদি অবাঙালি জাতিসত্তার লোকদের ওপর। হিন্দু-মুসলমান বাঙালি উভয়েই এই হামলা করছে। যদিও এই হামলাকারীদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি। তা হলেও এ ক্ষেত্রে এটা বিশেষ জোর দিয়ে বলা দরকার যে, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর এই আক্রমণের কোনো ধর্মীয় চরিত্র নেই। আছে শ্রেণীগত চরিত্র। শাসকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বাঙালি ভূমিদস্যুরাই আজ ব্যাপকভাবে এ কাজ করছে। কাজেই নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার ধাপ্পাবাজি চরিত্র উন্মোচন করে ভূমিদস্যুদের ক্রিমিনাল কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জনগণকে অবহিত করা এবং এর বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া সংখ্যালঘু জাতিসত্তার বিরুদ্ধে এই আক্রমণ প্রতিহত করার অন্য কোনো পথ নেই।
২.৬.২০১৪

সৌজন্যে: সমকাল

 

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More