রাঙামাটিতে আ. লীগের সমাবেশ ও বিলাইছড়িতে কিশোরী ধর্ষণ : দু’টি মন্তব্য

0

রাজনৈতিক ভাষ্য

এক.
গতকাল রবিবার আ. লীগ রাঙামাটি শহরে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে ও জন দুর্ভোগ সৃষ্টি করে সমাবেশ করেছে। এ সময়, আজ প্রথম আলোর রিপোর্টে যেমনটা বলা হয়েছে, ‘শহরের মূল সড়কে সমাবেশের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।’…‘সমাবেশকে ঘিরে সকাল থেকে শহরের বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।’ অর্থাৎ জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সমাবেশটির জন্য নিরাপত্তা বিধান করা হয়। এভাবে রাস্তায় চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে সমাবেশ করার অনুমতি প্রশাসন কীভাবে দিতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়।

কয়েকদিন আগে, ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমা শহীদ হন। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারি। এদিন তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত নারী পুরুষ খাগড়াছড়ি শহরে আসতে চাইলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়। এমনকি মিঠুন চাকমার মরদেহ স্বনির্ভরে তার পার্টি অফিসে নিতে দেয়া হয়নি।

রাঙামাটির সমাবেশ ও খাগড়াছড়ির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া – এ দুটি ঘটনা পাশাপাশি উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী প্রশাসন চরম পক্ষপাত দুষ্ট এবং তার আইনের প্রয়োগও সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। একদিকে কয়েকটি বিশেষ সংগঠনের ভূয়া কর্মসুচী নির্বিঘ্নে পালন করতে দেয়া হচ্ছে ; অন্যদিকে ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনকে শান্তিপূর্ণ সভায়, এমনকি মৃত ব্যক্তির দাহক্রিয়া অনুষ্ঠানে পর্যন্ত যোগদান করতে দেয়া হচ্ছে না। একদিকে বিশেষ সংগঠনের সমাবেশে পুলিশের বিশাল নিরাপত্তা বেষ্টনী, অন্যদিকে জনগণের ন্যায্য দাবিতে আয়োজিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের বাধা ও হামলা। একদিকে উগ্র সেটলার সংগঠনের নেতারা সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর হুমকি দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয় না ; অন্যদিকে জনগণের পক্ষের দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিনা কারণে গ্রেফতার করে জেল ভরে ফেলা হচ্ছে। আসলে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগের সমাবেশের উদ্দেশ্য ‘অস্ত্রবাজি, খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজির প্রতিবাদ’ নয় – কারণ সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ ধরনের অপবাধের সাথে সর্বদা জড়িত। প্রতিদিন পত্রিকা উল্টোলেই এ সংক্রান্ত খবর সবার চোখে পড়ে। আসলে রাঙামাটির ঐ সমাবেশের আসল উদ্দেশ্য হলো বিলাইছড়িতে মারমা কিশোরী ধর্ষণ ও তার বোনকে যৌন হয়রানি করার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে অপশক্তিকে সহায়তা করা।

দুই
রাঙামাটির বিলাইছড়ির এই যৌন সন্ত্রাসের ঘটনায় সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন বিক্ষুব্ধ। দোষী সেনা সদস্যদের গ্রেফতার দূরের কথা, বরং তাদের রক্ষা ও ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিছু দালাল ভাড়া করে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। আ. লীগের স্থানীয় নেতা রাসেল মারমা ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করলেও ঐ সংবাদ সম্মেলনে নিয়ে আসা ধর্ষিতারই ছোট ভাই স্পষ্টভাবে সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছে; বলেছে আর্মিরা কিভাবে ঘটনা ঘটিয়েছে সে সব কথা।

ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে রাঙামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাজা দেবাশীষ রায়, রাণী য়েন য়েন ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা খীসা  তাকে দেখতে যান। কিন্তু হাসপাতালের গেটে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাদের সাথে যে চরম অসৌজন্যমূলক ও অভদ্র আচরণ করেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তবে যুক্তি ও ন্যায়ের কাছে তারা (গোয়েন্দারা) শেষ পর্যন্ত হেরে যান।

উক্ত ধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে এখনো প্রতিবাদ হচ্ছে। আওয়ামী লীগও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারতো। কিন্তু তারা সেটা না করে ধর্ষকদের পক্ষ অবলম্বন করছে। শুধু এবার নয়, অতীতেও তারা কোন সময় নির্যাতিত অত্যাচারিত গণমানুষের পক্ষে কথা বলেনি। পাহাড়ে কত গণহত্যা, হামলা, ভূমি বেদখলের ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে, অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে আ. লীগ নেতারা বরাবরই নীরব। সভা সমাবেশ দূরের কথা তারা এসব অন্যায় অবিচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দু’এক লাইনের বিবৃতি পর্যন্ত দেন না।

গতকালের রাঙামাটির সমাবেশে অনির্বাচিত এক মহিলা এমপি ও আ.লীগ নেত্রী বলেছেন বিলাইছড়ির ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। রাণী য়েন য়েন কে ইঙ্গিত করেই নাকি তার এই অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো – ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, ধর্ষিতার প্রতি সমবেদনা জানাতে ও প্রকৃত ঘটনা জানতে তার কাছে যাওয়া যদি রাজনীতি হয়, তাহলে সেই রাজনীতি (বা আপরাজ নীতি যেই হোক) একবার কেন, শতবার, হাজার বার, লক্ষ কোটিবার করা উচিত। আমরা জানি চাকমা রাজা ও রাণী পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের শিকার হওয়া কিশোরীর জন্য বিশেষ কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তারা যেভাবে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আ. লীগের ঐ নেত্রীর কথায় মনে হয়, যারা ধর্ষণের বিচার চায়, অপরাধীর শাস্তি চায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায়, তারাই যেন অপরাধী। আর যারা ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চায়, ধর্ষককে আড়াল করতে চায়, তারাই সাধু, তাদেরই পোয়াবারো, তাদেরই দোর্দন্ত প্রতাপ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এটাই হয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। এখানে এখন, শেক্সপিয়রের ভাষায়, Fair is foul, foul is fair.ভিলেনরাই নায়ক, নায়করা ভিলেন। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন হবেই, যেমন করে শেষ বেলায় শেক্সপিয়রের নাটকের ম্যাকবেথের করুণ পরিণতি হয়েছে। (সমাপ্ত)
—————
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More