সরকারের নির্লিপ্ততা: ‘হেদো হেয়্যাত হুগুরে ভুগে পাহ্’

0

।। মন্তব্য প্রতিবেদন ।। চাকমা ভাষায় একটি বাগধারা আছে, তা হলো ‘হেদো হেয়্যাত হুগুরে ভুগে পাহ্’। এর আক্ষরিক তর্জমা হতে পারে ‘যেন হাতিকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ’। যখন আপনি কাউকে কোনো কিছুর ব্যাপারে অনুনয়, বিনয়, অনুরোধ অথবা সমালোচনা করার পরও সে নির্লিপ্ত থাকে, তখন এ বাগধারাটি তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়। বিশাল গতরওয়ালা হাতিকে কুকুররা ঘেউ ঘেউ করলেও হাতি তাতে কেয়ার করে না, নির্লিপ্ত থাকে, এবং আপন মনে চলে যায়। খুব সম্ভব এই পর্যবেক্ষণ থেকে এই বাগধারাটির উৎপত্তি। এর বাংলা সমকক্ষ ঠিক কী হবে তা এই মুহুর্তে মনে আসছে না, তবে ‘অরণ্যে রোদন’ অর্থের দিক দিয়ে কাছাকাছি হতে পারে।

Commentaryএইচএসসি পরীক্ষার্থী ও ছাত্র নেতা রমেল চাকমার সেনা হেফাজতে মৃত্যুর পর বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের জোরালো দাবি সত্বেও যেভাবে সরকার নির্লিপ্তভাব ধারণ করে আছে তা যেন ‘হ্েেডা হেয়্যাত হুগুরে ভুগে পাহ্’। কোন মহল থেকে এ দাবি উচ্চারিত হয়নি? রমেলের পরিবার ও পাহাড়ি সংগঠনগুলো ছাড়াও দেশের বিদগ্ধ নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, পত্রিকার সম্পাদকীয়, মিডিয়া, সাধারণ নাগরিক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র একই দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু তারপরও সরকার নির্লিপ্ত ও নির্বিকার, তার কর্ণকুহরে এসব দাবির আওয়াজ যেন কিছুতেই প্রবেশ করছে না। অথচ জনগণের প্রকৃত সরকার হলে, প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার হলে, দাবি না উঠতেই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হতো। কারণ যেভাবে ও যে পারিপাশির্^ক পরিস্থিতিতে রমেল চাকমার মৃত্যু হয়েছে তাতে তার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করা ও তার জন্য কেউ দায়ি হলে তাদের চিহ্নিত ও শাস্তির ব্যবস্থা করা সরকারের রুটিন দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অথচ এই অতি সাধারণ একটি দায়িত্ব পালনে তাকে বাধ্য করতেও কত আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়। তারপরও হয়তো দেখা যায় সরকারকে এক চুল পরিমাণও নড়ানো যায় না। এই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি।

রমেল চাকমার মৃত্যুর জন্য দায়ি করা হচ্ছে নান্যাচর জোনের সেনাদের। তবে আইএসপিআর বলেছে রমেল পুলিশী হেফাজতেই মারা যান, যা পুলিশ অস্বীকার করেছে। রাঙামাটির এসপি সাঈদ তারিকুল হাসান দাবি করেছেন প্রয়োজনে পুলিশের বিরুদ্ধেও তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। অপরদিকে সেনাবাহিনী নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করছে। সুতরাং তদন্তের ব্যাপারে নিশ্চয়ই তাদেরও আপত্তি থাকার কথা নয়। সেটলারদের একটি মহলের অভিযোগ রমেল চাকমার মৃত্যুর জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ি করা ষড়যন্ত্রমূলক। তারা রাঙামাটিতে এর বিরুদ্ধে মানববন্ধনও করেছে। তারাও নিশ্চয়ই চাইবে আর্মিদেরকে অভিযোগ থেকে দায়মুক্ত করা হোক এবং ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত ও বিচার করা হোক। আর এটা করতে হলে নিঃসন্দেহে তদন্তের প্রয়োজন, যা তারা স্বাভাবিকভাবে চাইবে বলে ধারাণা করা যায়। তাহলে তারপরও কেন সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে দেশেরই একজন নাগরিক রমেল চাকমার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করছে না? তাহলে কি সরকার তার মৃত্যু রহস্য ঢামাচাপা দিতে এবং অপরাধীদের বাঁচাতে চাইছে, যেভাবে কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের বেলায় ঘটেছে? এ যেন এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।

অথচ সরকার প্রতিদিন বলে বেড়ায় কেউ আইনের উর্ধে নয়, অপরাধী যেই হোক তাকে ধরা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু রমেল চাকমা হত্যার বেলায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো অসংখ্য অপরাধের বেলায় তো আমরা সরকারের এই কথার সাথে কাজের মিল দেখতে পাই না। তাহলে কি সরকারী কর্তাব্যক্তিদের এসব কথা কেবল মুখের আওয়াজ, কথার কথা? নাকি অভিযোগ ‘দেশপ্রেমিক’ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বলেই সরকার এমন আচরণ দেখিয়ে থাকে? যে সরকার বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে সে সরকারের কাছ থেকে আমরা এ ধরনের আচরণ আশা করি না। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সভ্য সমাজের প্রধান লক্ষণ। তাই সরকারকে এক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। উন্নত ও সভ্য সমাজকে অনুসরণ করতে হবে। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় আইন লঙ্ঘণ করলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত ছাড় দেয়া হচ্ছে না। পার্ক গিউন হাইকে ইমপিচ বা বরখাস্ত করে জেলে পাঠানো হয়েছে। আমাদের দেশে কি সে রকম অবস্থা চিন্তা করা যায়? আমাদের এ দেশে থাকতে হয় ক্ষমতাধরদের অপরাধ সহ্য করে। শত অপরাধ করেও তারা পেশীর জোরে, ক্ষমতার জোরে পার পেয়ে যায়। কিন্তু আর কতকাল এভাবে চলবে? রমেল চাকমার মৃত্যুর পর যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় বইছে তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এদেশের মানুষ বিদেশীদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরবে নিভৃতে যে অত্যাচার নির্যাতন অন্যায় চলছে তা আর মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সরকার যত দ্রুত এই বার্তা বুঝতে পারবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল।

আর গড়িমসি না করে সরকারের উচিত অবিলম্বে যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা, যে কমিটি রমেল চাকমার মৃত্যুর কারণ ও কারা এর জন্য দায়ি তাদের চিহ্নিত করবে। এটা করতে ব্যর্থ হলে আমরা বুঝবো সরকার পেশী শক্তির কাছে মাথা নত করে রমেল চাকমার মৃত্যুর জন্য দায়ি ব্যক্তিদের রক্ষায় সহায়তা দিচ্ছে। (সমাপ্ত)

________
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More