সাজেক রুইলুই পাড়ায় পর্যটন কেন্দ্র : ১০৫ পাহাড়ি পরিবারের উচ্ছেদ আতঙ্ক

0

সিএইচটিনিউজ.কম
Sajek porjoton2
সাজেক প্রতিনিধি: রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই পাড়ায় সেনাবাহিনীর নির্মিত পর্যটন কেন্দ্রের কারণে স্থানীয় ১০৫ পাহাড়ি পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন। পর্যটনের জন্য বিভিন্ন ভবন সম্প্রসারণের ফলে ওইসব নিরীহ পাহাড়ি পরিবারগুলো ক্রমান্বয়ে উচ্ছেদ হওয়ার পথে। ইতিমধ্যে পাঁচ পাহাড়ি পরিবারকে নিজ বাস্তুভিটা হতে উচ্ছেদ করে সেখানে সেনাবাহিনী একটি বিলাস বহুল থ্রি স্টার কটেজ নির্মাণ করেছে।

উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলো হচ্ছে- প্রেম লাল ত্রিপুরা, গুলফোজ ত্রিপুরা, মতিজয় ত্রিপুরা, ফাহিম ত্রিপুরা ও অন্ত কুমার ত্রিপুরা।

রুইলুই পাড়ায় বসবাসরত পাহাড়িদের ভিটেমাটি ও জমি বিভিন্ন কৌশলে এবং হুমকি-ধামকি দিয়ে বেদখলের চক্রান্ত চলছে বলে স্থানীয় পাহাড়িরা অভিযোগ করেছেন। শুধু সেনাবাহিনী নয়, জেলা প্রশাসকের বিশ্রামাগার নির্মাণের নামেও জমি বেদখলের পাঁয়তারা চলছে বলে তারা জানান। পাড়াবাসীর অভিযোগ, যুগ যুগ ধরে বসবাস করা ভূমি হতে অন্যত্র সরে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও প্রশাসন হতে বার বার তাদেরকে চাপ দেয়া হচ্ছে। পাড়ায় নতুন করে কোনো পাহাড়ি বাড়ি-ঘর নির্মাণ করতে চাইলে সেনা সদস্যরা বাধা প্রদান করছে।

সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের বিশ্রামাগার নির্মাণের নামে ১০(দশ) একর জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য স্থানীয় পাহাড়িদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পর্যটন কেন্দ্র সম্প্রসারণে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের নানা অপতৎপরতার ফলে পাহাড়ি পরিবারগুলো রীতিমত উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেনSajek porjoton

স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক মাস আগে কানুনগো-প্রকৌশলী দিয়ে রুইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে  জুয়ালা লুসাই-এর ৫(পাঁচ) একর বন্দোবস্তিকৃত জমি পরিমাপ করা হয়েছে। জমি পরিমাপ করার সময় জমির মালিককে খাস জমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ সেই জমিতে জুয়ালা লুসাই সহ অন্য জমির মালিকরা দীর্ঘ প্রায় দুইশত বছর ধরে বসবাস ও ভোগদখল করে আসছেন। সেনা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এলাকার যাবতীয় জমি সরকরি খাস জমি দাবি করে স্থানীয় পাহাড়িদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালাচ্ছে।

স্থানীয়দের আরো অভিযোগ, রুইলুই পাড়ায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ও সেখানে পর্যটক আসার পরপরই সমাজে নানা বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের পূর্বে সামাজিক শৃংখলা মোটামুটি ভালোই ছিল। বর্তমানে পর্যটকদের আচরণ অনুকরণ করে পাড়ার কিশোর-কিশোরীসহ স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও মাদকে ডুবছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে স্থানীয়রা নেশাদ্রব্য পান করছে। এছাড়া নানা অসামাজিক কার্যকলাপেও লিপ্ত হয়ে পড়ছে সকল বয়সী মানুষ। অথচ পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার পূর্বে পাড়াটিতে সুশৃংখল অবস্থা বজায় ছিল। এখন ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা হতে আসছে নানা ধরনের মাদক। তাছাড়া স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে পাঁচ থেকে সাতটি দেশীয় মদ তৈরির কারখানা। দেশী-বিদেশী মাদকে ছেয়ে গেছে রুইলুই পর্যটন পাড়া।

দেখা গেছে, পর্যটন কেন্দ্রের প্রবেশ ফটকে পর্যটক ছাড়াও স্থানীয়দের চলাফেরার জন্য প্রতি জন থেকে বিশ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। প্রতি মোটর সাইকেল থেকে একশত টাকা ও চাঁদের গাড়ি (জিপ) থেকে একশত টাকা আদায় করা হচ্ছে। সেই ফটকের কারণে ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

Sajek porjoton1রুইলুই পাড়ার জগদীশ ত্রিপুরা, মনি ত্রিপুরা ও মুখচারা ত্রিপুরা অভিযোগ করে বলেন, আমাদের পাড়াতে এখন নতুন করে কোনো বাড়িঘর নির্মাণ করতে পারছি না। বাড়িঘর নির্মাণ ও সংস্কার বা মেরামত করতে চাইলে সেনাবাহিনী বাধা প্রদান করে থাকে। আমরা শুনছি, আমাদেরকে এখান থেকে উচ্ছেদ হতে হবে। তারা হতাশার সুরে বলেন, আমরা নিরীহ মানুষ, আমরা কোথায় যাবো?? তাদের মতে, রুইলুই পাড়ায় ত্রিপুরা পরিবারের সংখ্যা ৭৯টি।

রুইলুই মৌজার হেডম্যান লাল থাংয়া লুসাই বলেন, রুইলুই পাড়ায় ত্রিপুরা, পাংখোয়া ও লুসাই মিলে মোট ১০৫ পরিবার বসবাস করছে। এখানে বসবাস ও চাষযোগ্য জমি অত্যন্ত কম। পাহাড় ব্যতিত চাষযোগ্য ধান্যজমি মোটেও নেই। তারপরও সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা আমার কাছ থেকে জমি চায়। আমি জমি দিতে না চাইলে নানাভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চৌধুরী দশ একর জমি দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। আমি রাজী না হলেও জুয়ালা লুসাই সহ বিভিন্ন জনের জমি কানুনগো দিয়ে পরিমাপ করা হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দুইশত বছর যাবৎ বসবাসরত জায়গা হতে ১০৫ পাহাড়ি পরিবারকে উচ্ছেদ হতে হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রুইলুই পাড়া পরিদর্শনে গেলে সে সময় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা সেখানে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দেন। এরপর ৬ নভেম্বর রুইলুই সেনা ক্যাম্পে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা সহ স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলোচনা সভায় চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল মো: সাব্বির আহম্মেদ পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দেন। সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে নামমাত্র ও লোকদেখানো একটি পর্যটন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। মূলতঃ সেই কমিটির কোন কার্যকারিতা এখন আর নেই। বর্তমানে সেনাবাহিনী-ই পর্যটন কেন্দ্রের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। কমিটি গঠনের প্রাক্কালে বলা হয়েছিলো পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হলে স্থানীয়রা সুফল ভোগ করবেন। তাদের ভিটেমাটি হতে উচ্ছেদ হতে হবে না। কিন্তু বাস্তবে যেটা পরিলক্ষিত হচ্ছে- স্থানীয়রা সুফল ভোগ করার পরিবর্তে জোরপূর্বক উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন। অপরদিকে, পর্যটন কেন্দ্র থেকে আয়ের টাকা খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের একটি ক্লাবে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
———————–

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More