সেনাসৃষ্ট মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার গৌরবোজ্জ্বল প্রতিরোধের দিন ৭ মার্চ

0

খাগড়াছড়ি : আজ ৭ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ একটি দিন।  ১৯৯৬ সালে এ দিন সেনাসৃষ্ট মুখোশবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে খাগড়াছড়ি সদরে সর্বস্তরের জনতা লাঠিসোটা নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল। সেদিন জনতা বীরত্বের সাথে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করে ক্যান্টনমেন্টের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এ সময় মুখোশবাহিনীকে সহায়দানকারী সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন ২০ বছরের টগবগে যুবক অমর বিকাশ চাকমা। জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে পরবর্তী সময়ে সরকার ও সেনাবাহিনী মুখোশবাহিনী ভেঙে দিতে বাধ্য হয়। আর সেদিনের সাহসী ভূমিকা ও আত্মবলিদানের সম্মানস্বরূপ খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজার হতে দক্ষিণ খবংপয্যা-কাশেম স’মিল সড়কটি নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ অমর বিকাশ চাকমা সড়ক’ নামে।

ঘটনার দিন গভীর রাতে মুখোশবাহিনীর সন্ত্রাসীরা দুই পিক-আপ সেনা সহায়তায় পেরাছড়ায় এক রাজনৈতিক কর্মীকে অপহরণ করতে গেলে  প্রতিবেশীদের ‘মুখোশ, মুখোশ বাহিনী এসেছে’ চিৎকারে মুহুর্তের মধ্যে পেরাছড়ায় লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে নেমে পড়ে। এলাকায় দস্যু মুখোশবাহিনী আসার খবর বিদ্যুত বেগে ছড়িয়ে পড়লে নিকটস্থ সিঙ্গিনালা, রাবার ফ্যাক্টরি, স্টেডিয়াম এলাকা, খবংপুজ্জ্যা, নারাঙহিয়া ও মা’জনপাড়ার শত শত লোক লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। পেরাছড়া ও স্বনির্ভরবাজারের মধ্যস্থল স্টেডিয়াম সংলগ্ন পানছড়ি সড়কে জনতা এক প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করে। হামলাকারীরা স্ট্রিট লাইট আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল। মুখোশবাহিনীকে সহায়তাদানকারী রাস্তায় দাঁড়ানো দু’টি পিক-আপের হেডলাইটও নিভিয়ে রেখেছিল সেনা সদস্যরা।

# সেনাসৃষ্ট মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার লাঠি মিছিল। ছবিটি ১৯৯৬ সালে তোলা। # ফাইল ছবি

উত্তেজিত জনতাকে ভয় দেখাতে মুখোশবাহিনী ককটেল ফাটালে, তাতে লোকজন আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ‘ধর! ধর!’ বলে ক্রুদ্ধ জনতা এগুতে থাকে। ক্রুদ্ধ জনতাকে সন্ত্রস্ত করতে সেনা সদস্যরা ফায়ার করলে তা যেন অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মত অবস্থার সৃষ্টি হয়! অমর বিকাশ চাকমা গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ আর সিন্ধু বিকাশ চাকমা ও বিজয় কান্তি মারমা জখম হলেও তাতে দমে যায়নি প্রতিবাদী জনতা। আত্মরক্ষার্থে পজিশান নিয়ে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে ক্রুদ্ধ জনতা অগ্রসর হতে থাকে। ভোর রাত তিনটা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। উত্তাল সমুদ্র তরঙ্গের মত জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে দুই পিক-আপ সেনা জওয়ান মুখোশদের নিয়ে পিছু হটতে থাকে। জনতাও তাদের পিছু নেয়। এভাবে ধাওয়া করতে করতে খেজুড়বাগান উপজেলা পর্যন্ত সেনা-মুখোশবাহিনীকে জনতা তাড়িয়ে নিয়ে যায়। জনতার তাড়া খেয়ে সেনা জওয়ান-মুখোশবাহিনী চেঙ্গীস্কোয়ার হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও পাহাড়ি গণপরিষদ (পিজিপি)-কে গণতান্ত্রিক পন্থায় মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল(অব:) অলি আহম্মদের প্রত্যক্ষ মদদে ও খাগড়াছড়ি ২০৩ সেনা ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে সমাজের বখাটে যুবকদের নিয়ে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি করা হয়, যা স্থানীয়দের কাছে ‘মুখোশবাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের মাধ্যমে এলাকার পরিস্থিতি অস্থির করে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমাধান বাধাগ্রস্ত করাই ছিল এর লক্ষ্য। সেনাবাহিনীর ছত্র ছায়ায় থেকে মুখোশ বাহিনীর সন্ত্রাসীরা এলাকায় ব্যাপক তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল।

গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে এ দিন সাহসিকতা বীরত্ব ও সংগ্রামী ঐক্যের এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।  ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে সরকার আর সন্ত্রাসী মুখোশবাহিনীকে মাঠে নামাতে পারেনি।

স্মর্তব্য যে, ’৯৬ সালে মুখোশবাহিনীর হোতা খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের তৎকালীন জি-টু মেজর মেহবুব দুর্নীতির দায়ে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হয়। পরে পদচ্যুত মেহবুব ঢাকা উত্তরায় দাগী অপরাধীচক্রের সাথে যুক্ত হয় এবং অপহরণ করতে গিয়ে মাইক্রোবাসসহ ধৃত হয়ে তার সাজা হয়। সমাজে ধিক্কৃত ঘৃণিত মুখোশদের পরিণতি হয় করুণ।

আজকের দিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন সংগ্রামে সেনাসৃষ্ট মুখোশ বাহিনী প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পরিগণিত। প্রতি বছরই পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনত লড়াকু সংগঠনসমূহ দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

দিবসটি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে লড়াকু তিন সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন খাগড়াছড়িতে শহীদ অমর বিকাশের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ছাত্র-যুব-নারী সমাবেশ এবং ঢাকায় লাঠি মিছিলের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
—————–
সিএইচটিনিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্রউল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More