হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলা করছে কারা?

0

– বদরুদ্দীন উমর

cropped-umor-vai013বাংলাদেশে এখন ঠিক কী হচ্ছে এটা আওয়ামী লীগের ঢাকঢোল পেটানো ও বাদ্যবাদনের কারণে বোঝা মানুষের পক্ষে সহজ হচ্ছে না। সরকারি প্রচার-প্রচারণার মহিমায় সব সত্য আড়ালে চলে যাচ্ছে। কী ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ এখন দিন-রাত্রি যাপন করছেন এটা নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী ধুমধাড়াক্কার মাধ্যমে কীভাবে জনগণের দৃষ্টির বাইরে রাখা হচ্ছে তা বোঝা গেলে বাংলাদেশের প্রকৃত ভয়াবহ পরিস্থিতির চিত্র উন্মোচিত হবে। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করছে, তাকে প্রশংসার যোগ্য মনে করার কারণ নেই।

আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে অহরহ নিজের প্রচার চালিয়ে গেলেও কোনোদিনই তারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো সোচ্চার বক্তব্য দেয়নি। পাকিস্তানি আমলেও পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে লুটপাট চালানো বিষয়ে তাদের কণ্ঠ খুব জোরালো হলেও ছয় দফার মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধিতার কোনো নামমাত্র উল্লেখও ছিল না। অবশ্য তখন দেশে জনগণের মধ্যে ও কিছু লেখক ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী যে আন্দোলন দেখা গিয়েছিল, তার প্রভাব তাদের একটা অংশের ওপর পড়েছিল। ১৯৭১ সালের পর ভুট্টো এবং ১৭৫ জন সামরিক যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করা হয়েছিল। প্রধান বেসামরিক যুদ্ধাপরাধী ভুট্টোকে বাংলাদেশে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নিয়ে এসে ঢাকঢোল পিটিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল! যে দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের এখন বিচার হচ্ছে তাদের মাফ করে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে সমন্বয় রেখে নির্বাচন করেছিল। ১৯৯৬ সালে তারা জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামীর সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করেছিল। এরশাদ সংবিধানের সংশোধনী করে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম করা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ তাদের ১৯৯৬ এবং ২০০৯ সালের সরকার আমলে তা বাতিল না করে আজ পর্যন্ত বহাল রেখেছে! এসবই হচ্ছে আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরই পরিচায়ক। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট প্রচার-প্রচারণার কারণে এসবই আড়ালে রেখে আওয়ামী লীগ এখন নিজেকে অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন বলে প্রচার করে নির্বাচনী ফায়দা বেশ সাফল্যজনকভাবে অর্জন করেছে। এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মিথ্যার জয়জয়কার হয়ে দেশে এক সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানি আমলের ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ বাতিল না করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তার নাম রেখেছিল ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’! তারা যদি প্রকৃতপক্ষে অসাম্প্রদায়িক হতো তাহলে তারা উপরোক্ত কুখ্যাত আইনটি কেন রদ করেনি এটা যে কোনো গণতন্ত্রী ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ব্যক্তি তাদের জিজ্ঞেস করলে কি দেশদ্রোহিতা ও সাম্প্রদায়িক হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা চলে? না এর জন্য আওয়ামী লীগ যে নিজেই বাস্তবত একটি সাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন দল, এটা প্রমাণসিদ্ধ হয়?

untitled-20_32721

‘অর্পিত সম্পত্তি আইনে’র ছাতার তলায় বাংলাদেশে হিন্দু সম্পত্তি কারা দখল ও লুটপাট করেছিল? কেন আওয়ামী লীগ আমলে হাজার হাজার হিন্দু দেশত্যাগ করে ভারতবাসী হয়েছিলেন, এটা কি জিজ্ঞেস করার মতো বিষয় নয়? হিটলার বলেছিল, একটা মিথ্যা বারবার বললে সেটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায় এক বাস্তব ব্যাপার। আওয়ামী লীগের প্রচার-প্রচারণার কারণে বাংলাদেশে এটাই হয়েছে। বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা অসাম্প্রদায়িক হিসেবে এক ধরনের পরিচিতি লাভ করে ক্ষমতার জোরে এখনও পর্যন্ত তাদের সাম্প্রদায়িক তৎপরতা বজায় রেখেছে এবং জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে তাদের বাড়িঘর-সম্পত্তি লুটপাট করছে। বিএনপি-জামায়াতের লোকদের সঙ্গে মিলে কক্সবাজারে বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের বাড়িঘর, মন্দির ও বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করার পর আওয়ামী লীগ মন্দির ও মূর্তি নতুন করে নির্মাণ করে ‘অসাম্প্রদায়িক’ হিসেবে নিজেদের বড় রকম প্রচার চালালেও মন্দির উদ্বোধনের সময় বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণকারী আওয়ামী লীগওয়ালাদের উপস্থিতি তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল, সেটা উপেক্ষার বিষয় নয়। সেই হামলার ব্যাপারে সরকার যে কোনো তদন্ত করেনি এটাও বৌদ্ধদের দৃষ্টি এড়ায়নি। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দেওয়া শুরু হওয়ার সময় থেকে বাংলাদেশে নতুনভাবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কি জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা আছে? জনগণ কি সাম্প্রদায়িক হয়ে এ নিয়ে মাতামাতি করছে? জামায়াত-শিবির হিন্দুদের ওপর হামলা অনেক ক্ষেত্রে করছে। কিন্তু এসব ঘটনার কোনোটির কি বিচার হয়েছে? ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মাতামাতি করলেও সদ্য সংঘটিত এসব ঘটনার একটিরও কি কোনো সরকারি তদন্ত হয়েছে? এসব প্রশ্ন কি করা যায় না? না করা হয়ে থাকলে এটা অবশ্যই করা দরকার। সেটা করলে দেখা যাবে যে, শুধু জামায়াত-শিবির বা বিএনপিই নয়, আরও ব্যাপকভাবে এই সাম্প্রদায়িক হামলা আওয়ামী লীগের লোকদের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছে। এটাই কারণ যে জন্য এসব হামলার কোনোটিরই কোনো তদন্ত আজ পর্যন্ত হয়নি।

‘হিন্দুদের ওপর হামলার বিচার হচ্ছে না কেন?’ এ বিষয়ে ৯ জানুয়ারি বিবিসি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সমিতির নেতা সুব্রত চৌধুরীর এক সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাতে তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের বিষয়ে বিভিন্ন দলের পরস্পরের প্রতি দোষারোপ একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেমন বলা হচ্ছে জামায়াত-শিবির এটা করছে। এটা একটা স্লোগান হয়ে গেছে। বাস্তবে দেখা যাবে, সব জায়গায় জামায়াত-শিবির করেছে, বিষয়টি এ রকম নয়। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকও জড়িত হয়েছে, সেটা আমরা দেখতে পেয়েছি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি জামায়াত-শিবির হামলা করে থাকে বা আর যেই করুক না কেন, সরকার তার বিচার করছে না কেন? তিনি আরও বলেন, হামলার ঘটনা বন্ধ করতে প্রশাসনের যেসব কর্মচারী ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

একটি পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক লিখেছেন যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থিরা দেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটাচ্ছে, এটা বন্ধ করতে হবে এবং এ জন্য দরকার হলে লাখ লাখ লোককে মেরে ফেলতে হবে! আওয়ামী লীগের এসব বুদ্ধিজীবী যেভাবে তাদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে এই ফ্যাসিস্ট কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডের দ্বারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা যে বাস্তবত শক্তিশালী হচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও লুটপাটের সঙ্গে তাল রেখে তাদের ‘সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী’ তৎপরতা চালিয়ে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভূমিকা আড়াল করে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ঘটিয়ে এসেছে এবং এখনও সেই প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। পূর্বোক্ত অধ্যাপকের বক্তব্য তারই এক উদাহরণ। এ ধরনের অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীর অভাব এখন বাংলাদেশে নেই।

বদরুদ্দীন উমর
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল
১৩.১.২০১৪

 

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More