জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধিদের সাক্ষাত

0

ঢাকা : খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির একটি দল গতকাল রবিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. রিয়াজুল হকের সাথে সাক্ষাত করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সার্বিক বিষয়ে অবহিত করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এ সময় তাঁরা ৭ দফা দাবি ও প্রস্তাবনা সম্বলিত একটি  স্মারকলিপিও পেশ করেন।

প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন লক্ষীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা, রাঙামাটি জেলার নান্যাচর উপজেলার ২ নং নান্যাচর সদর ইউপি চেয়ারম্যান জ্যোতিলাল চাকমা ও একই উপজেলার ৩নং বুড়িঘাট ইউপি’র চেয়ারম্যান প্রমোদ বিকাশ খীসা।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের বরাবরে দেয়া স্মারকলিপিতে বলা হয় হয়, বাংলাদেশের মত পশ্চাৎপদ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি বিধায় এখানে অন্যায় কর্তৃত্ব ও জবরদস্তি প্রাত্যাহিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহ কর্তৃক সাধারণ নাগরিকগণ নানাভাবে নিগৃহীত হয়ে আসছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ‘অপারেশন উত্তরণ’ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘১১দফা নির্দেশনা’ জারি থাকায় এখানে মৌলিক মানবাধিকার প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, সরকারি বিধিনিষেধের ফাঁক গলিয়ে তা কখনও কখনও প্রকাশ পেয়ে থাকে। নিরাপত্তাবাহিনী তথা রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ পাহাড়ি জনগণের নিরাপত্তা ও জীবনের হুমকি সৃষ্টি করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশেষ করে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের মারমুখী তৎপরতা দেশে-বিদেশের পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, বিশিষ্টজনেরা তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামেও আসন্ন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে সেনা ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অন্যায় ধরপাকড়, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের অব্যাহত রয়েছে। প্রত্যক্ষ সেনা মদদে একটি সশস্ত্র ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী মাঠে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। এ গোষ্ঠীটি গেল ১৮ আগস্টখাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে নারকীয় হত্যাকাণ্ড, ১৮ মার্চ চাঞ্চল্যকর মন্টি-দয়াসোনা চাকমা অপহরণসহ খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে খুন-অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়-চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। ৩ মে নান্যাচরে অজ্ঞাত সশস্ত্রগোষ্ঠীর হাতে শক্তিমান চাকমা নিহত হবার ঘটনায় যে হারে পাইকারিভাবে সাধারণ লোকসহ জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে, তাতে বিশেষ উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীলতা সহজেই অনুমেয়।

তাঁদের ভোগান্তির কথা তুলে ধরে এতে বলা হয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়েও জনগুরুত্বসম্পন্ন কার্যাদি সম্পাদন দূরের কথা, পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে তাঁরা বর্তমানে নিজ নিজ দপ্তরেও যাবার সাহস পাচ্ছে না। গেল ২৪ জানুয়ারি নানিয়ারচর উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভা শেষে ফেরার পথে চার ইউপি চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন মেম্বারকে অপহরণের প্রচেষ্টা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। প্রশাসন-পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমানে তাঁরা সাধারণ নাগরিকের মতো চলাফেরা করতে পারছেন না, এলাকাছাড়া ও ঘরছাড়া হয়ে পড়ে রয়েছেন। সাধারণ জনগণ এখন নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের সৃষ্ট স্থানীয় দুর্বৃত্তদের নিকট জিম্মি হয়ে পড়েছে।

স্মারকলিপিতে উল্লেখিত সাত দফা দাবি ও প্রস্তাবনাগুলো  হচ্ছে- (১) পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে মানবাধিকার সুরক্ষার্থে তিন পার্বত্য জেলায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি/মুখপাত্র নিয়োগদান। (২) মাসিক প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্কীকরণ করা। (৩) মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক পার্বত্য এলাকায় নিয়মিত পরিদর্শন, সেনা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক ও মানবাধিকার সুরক্ষার তাগিদ প্রদান। (৪) পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত সংঘটিত খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও গুমের ব্যাপারে দ্রুত আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাগিদ প্রদান। (৫) জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ষড়যন্ত্রমূলক মামলাপ্রত্যাহার এবংসুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় ও হয়রানি বন্ধ করতে সরকার-প্রশাসনকে তাগিদ প্রদান।  (৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার এবং এ ধরনের কাউকে নিয়োগ না দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নিকট আহ্বান জানানো। (৭) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকার-প্রশাসন যাতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাগিদ প্রদান।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রতিনিধি দলের বক্তব্য মনযোগ দিয়ে শুনেন। তিনি লিখিত আকারে পেশ করা দাবি ও প্রস্তাবনাসমূহকে খুবই যথোপযুক্ত আখ্যায়িত করে বলেন, কমিশন ১ নং দাবি ইতোমধ্যে বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অন্য দাবি ও সুপারিশসমূহ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি পরবর্তীতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেখানকার মানবাধিকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন এবং সেখানে সাক্ষাত করতে যাওয়া জনপ্রতিনিধিদেরও আমন্ত্রন জানাবেন বলে জানান।

সাক্ষাতের সময় কমিশনের চেয়ারম্যান ছাড়াও অন্যতম সদস্য অধ্যক্ষ বাঞ্চিতা চাকমাও ‍উপস্থিত ছিলেন।
_________

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More