আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রামে কি করেছে?

0

বিশেষ প্রতিবেদন, সিএইচটিনিউজ.কম

chittagong Hill Tracts map2দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশে সরকার গঠন করে। এই স্বাধীনতা যুদ্ধে ইচ্ছে ও আকাঙ্খা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি। এর পেছনে ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সুগভীর ষড়যন্ত্র। যা আজ পর্যন্ত চলমান রয়েছে।

স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ একদিকে সারাদেশে লুটপাট চালাতে থাকে, আবার অপরদিকে একক জাতিরাষ্ট্র গঠনের নামে দেশে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ওপর বাঙালী জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়। এই বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রচনা করা হয় বাংলাদেশের সংবিধান। ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ও তাঁর সাথে থাকা অন্য প্রতিনিধিদেরকে চরমভাবে অপমাণিত করেন। তিনি তার নিকট পেশ করা স্মারকলিপি ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং লারমাদেরকে উপদেশ দিয়ে বলেন, “তোমরা তোমাদের জাতিগত পরিচয় ভুলে যাও এবং বাঙালি হয়ে যাও”।শুধু তাই নয়, তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, লারমা তুমি বেশী বাড়াবাড়ি করে না। প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক…দুই…দশ লাখ বাঙালি ঢুকিয়ে দিয়ে তোমাদের জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলে দেয়া হবে। ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটিতে সফরে গিয়ে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমার একইভাবে পাহাড়িদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘আমরা এখন সবাই বাঙালী। আমি আজ থেকে তোমাদেরকে বাঙালীতে প্রমোশন দিলাম’। জুম্ম জনগণ শেখ সাহেবের ঐ দম্ভোক্তি ও পাহাড়ি নেতাদের অপমানের প্রতিশোধ নেন ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে। এই নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আসনসমূহে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটে। জনগণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করে রায় দেন। এরপর ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও জুম্ম জনগণ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদেরকে পরাজিত করেন। মোট কথা ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত হতে পারেনি।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শাসনামল তিন পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব হচ্ছে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আর তৃতীয় পর্ব হচ্ছে ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত।

প্রথম পর্বের আলোচনা উপরে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হয়েছে। এই পর্বে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় নীতি ঠিক করে নেয়। পরবর্তীতে সামরিক বেসামরিক সরকার সমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামে যা করেছে তা কেবল এই নীতিরই ধারাবাহিকতা বা তার বাস্তবায়ন।

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের ৬নং ধারায় লেখেন, বাংলাদেশের নাগরিকবৃন্দ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন। শেখ সাহেবের ঐ বাঙালি হয়ে যাওয়ার নির্দেশ কেবল কথার কথা ছিল না। তিনি পাহাড়িদেরকে জোরপূর্বক বাঙালি জাতীয়তাবাদে একীভূত করার জন্য আয়োজন শুরু করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণ আর বাঙালিদের অবাধে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে সপরিবারে নিহত হলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়।

এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। শুরু হয় দলটির দ্বিতীয় পর্বের শাসনামল। এ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করে। এর আগে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ জয়যুক্ত হয়েছিল। এই দু’টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত হওয়ার পিছনে কারণ হচ্ছে জনসংহতি সমিতির ভুল সিদ্ধান্ত। তারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিনাশর্তে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সমর্থন জানায়। ’৯৬ সালের এ নির্বাচনের ৭ ঘন্টা আগে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলেও কল্পনাকে উদ্ধারে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। বরং অপহরণ ঘটনা ধামাচাপা দিতে নানা কূটকৌশল প্রয়োগ করেছিল।

এ যাত্রায়ও আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সাথে চরমভাবে প্রতারণা করে। তথাকথিত “শান্তি চুক্তি” নাম দিয়ে একটা অসম চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে নিরস্ত্র করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও পাহাড়ি জনগণের সংগঠিত শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। যে চুক্তি আজ ১৬ বছরেও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে জেএসএস বার বার অভিযোগ করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প ও সেনা শাসন তুলে নেয়া হয়নি। প্রত্যাহার করা হয়নি বেআইনী অনুপ্রবেশকারী বাঙালিদের। ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি ভূমি অধিকার। বন্ধ হয়নি নিপীড়ন-নির্যাতন ও ভূমি বেদখল। আসলে এ চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলেও মৌলিক ইস্যুগুলো (ভূমি অধিকার, অনুপ্রবেশকারী বাঙালীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার…) বাদ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে এমনটা মনে করেন না পাহাড়িরা।

আওয়ামী লীগের তৃতীয় পর্বের শাসনামল শুরু হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি আসন কব্জা করে নেয়। বর্তমান পর্যন্ত দলটি ক্ষমতাসীন রয়েছে। এ পর্বেও দলটি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আশ্বাসবাণী শুনিয়ে ৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের চলতি এই পাঁচ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা। নীচে সংঘটিত কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো:

২০১০ সালের ১৯, ২০ ও ২৩ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটির সাজেক ও খাগড়াছড়ি শহরে পাহাড়িদের উপর হামলা চালানো হয়। এতে ২ পাহাড়িকে হত্যা ও  কমপক্ষে ৫ শতাধিক শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই করে দেয়া হয়।

২০১১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটির লংগদুতে কয়েকটি পাহাড়ি গ্রাম পুড়ে ছাই করে দেয়া হয়। একই বছর ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ের শনখোলা পাড়াসহ কয়েকটি পাড়ায় এবং মানিকছড়ি সদরের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা ও আগুন দিয়ে পাহাড়িদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ হামলায় আশীষ চাকমা নামে এক ছাত্র নিঁখোজ হয়ে যায়। এছাড়া একই বছর ১৪ ডিসেম্বর বাঘাইছড়ি ও দিঘীনালায় পাহাড়িদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। এতে দিঘীনালার কবাখালীতে চিকন মিলা চাকমা নাকে একজনকে হত্যা করা হয়।

২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয় রাঙামাটি শহরে। এ হামলায় শিক্ষক, চিকিৎক, জনপ্রতিনিধিসহ শতাধিক পাহাড়ি মারধরের শিকার হন। একই বছর বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চাক জাতিসত্তাসমূহকে নিজ পাড়া থেকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে।

২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারী খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার হরিধন মগ পাড়া ও হেমঙ্গ কার্বারী পাড়ায় সেটলাররা হামলা চালায়। এতে ৩০টির অধিক পাহাড়িদের ঘরবাড়ি পুড়ে দেয়া হয় এবং ব্যাপকভাবে ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মাটিরাঙ্গার তাইন্দং-তবলছড়ি এলাকায় পাহাড়িদের গ্রামে হামলা ও উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে।

৩ আগস্ট ২০১৩ মাটিরাঙ্গার তাইন্দংয়ে চালানো হয় বর্বর তান্ডবলীলা। এ হামলায় বৌদ্ধ মন্দিরসহ ৩৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, ১২টি গ্রামের তিন সহ¯্রাধিক পাহাড়ি ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। চালানো হয় ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট। এখনো দগদগ করছে এ হামলার ক্ষতচিহ্ন।

এ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের পাহাড়িদের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত হচ্ছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘বাঙালি’ বানানো। সংখ্যাগরিষ্টের জোরে সরকার এ সিদ্ধান্ত সংখ্যালঘু জাতির জনগণকে চাপিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে, যে সময় সংসদে এ বিতর্কিত বিল পাস করা হচ্ছিল সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত তিন পাহাড়ি এমপি এর কোন প্রতিবাদ না করে টেবিল চাপড়ে বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।

মোট কথা, পাহাড়ি দরদী ভাণ করা আওয়ামী লীগ কতটা সাম্প্রদায়িক তা উপরোক্ত ঘটনার মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত হয়। যদিও দলটি নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে পরিচিত করাতে চায়। মূলত: আওয়ামী লীগের মূল নীতিই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক। দলটি ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিলেও তার নীতির কোন পরিবর্তন করেনি। যার কারণে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এখনো বহাল রয়েছে। এই নীতির মাধ্যমেই দলটি অন্যান্য দলের মতো পাহাড়িদের উপর শোষণ-নির্যাতন চালাচ্ছে এবং উগ্রবাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়েছে।

আসলে আওয়ামী লীগ পাহাড়ি দরদী সেজে পার্বত্য চট্টগ্রামের সহজ-সরল পাহাড়িদেরকে সুবিধাবাদী-ধান্ধাবাজি রাজনীতির সাথে যুক্ত করে ফায়দা লুটে যাচ্ছে। এর ফলে সমাজে মানুষের মধ্যে দিন দিন সুবিধাবাদী-ধান্ধাবাজি ও লেজুরবৃত্তির মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই, এসব দলের সংশ্রব থেকে পাহাড়িদের বেরিয়ে এসে নিজস্ব শক্তির উপর দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সচেতন মহল।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More