মতামত

করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধে সরকারকে যা করতে হবে

0

সচেতন চাকমা

সরকার করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য বর্তমানে দেশব্যাপী ‘কঠোর’ লকডাউন জারী করেছে এবং সেটা কার্যকর করার জন্য পুলিশের পাশাাপাশি র‌্যাব ও সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামিয়েছে। লকডাউনের নিয়ম অমান্যকারীকে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। ১লা জুলাই থেকে লকডাউন শুরুর পর কয়েক হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও লোকজনকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। রাস্তায় ও অলি-গলিতে প্রতিদিন মানুষ ও গাড়িঘোড়ার আনাগোনা ও ভিড় বেড়ে চলেছে। রাজধানীতে এই চিত্র বিশেষভাবে প্রকট।

অন্যদিকে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। অক্সিজেন, রোগীর শয্যা, ডাক্তার ও নার্সের সংখ্যা নিতান্ত অপ্রতুল। এক কথায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। মূলত ভাইরাসটির মোকাবিলায় সরকারের যথাযথ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার অভাবই এর জন্য দায়ি। গত বছর সংক্রমণের শুরুর দিকে এবং সম্প্রতি এর দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগে সরকার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে পেলেও তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।

বার বার চেষ্টা করেও লকডাউন কেন কাযকর করা যাচ্ছে না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট ভাববার দরকার রয়েছে। কারণ ছাড়া কার্য হয় না। লকডাউন অকার্যকর হওয়ার পেছনেও অবশ্যই কারণ রয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত না করে এবং তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া না হলে সরকারের করোনা ভাইরাস মোকাবিলার প্রচেষ্টা কখনই ফলপ্রসু হবে না। আমাদের বিবেচনায় লকডাউন কার্যকর না হওয়ার পেছনে নিম্নোক্ত কারণ দায়ি:

১) লকডাউনের জন্য যথেষ্ট ও যথাযথ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার অভাব বা ঘাটতি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আগে যে পরিমাণ গ্রাউন্ডওয়ার্ক করা দরকার তা না করা।

২) শাসক শ্রেণীর আইন অমান্য করার সংস্কৃতি। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে সংস্কৃতি শ্রেণী-নিরপেক্ষ হতে পারে না এবং একটি নির্দিষ্ট সমাজে শাসক শ্রেণীর সংস্কৃতিই সাধারণত প্রাধাণ্যে থাকে। সাধারণ জনগণ প্রতিদিন দেখতে পায় যে, শাসক ক্ষমতাবানরাই প্রতিনিয়ত আইন লঙ্ঘন করছে, একই আইন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না এবং যে যতবেশী আইন লঙ্ঘনকারী সেই যেন তত বেশী ক্ষমতাবান। জনগণের মধ্যে এই যে আইন অমান্য করার একটা প্রবণতা তা আসলে শাসকগোষ্ঠীর এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। তা না হলে এই দেশেরই মানুষ অন্য দেশে বাস করে সে দেশের আইন-কানুন দিব্যি মেনে চলে, অথচ এদেশে অমান্য করবে কেন?

৩) লকডাউন ঘোষণার আগে গরীব দুঃস্থদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও রসদের ব্যবস্থা না করা, যার জন্য জীবনের তাগিদে তাদেরকে লকডাউন উপেক্ষা করতে হচ্ছে। আরব কবি মাহমুদ দারবিশ তার একটি বিখ্যাত কবিতায় লিখেছেন, Beware, beware of my hunger. আসলেই ক্ষুধার্তরা কিছুই ভয় করে না। না করোনা, না আইন।

৪) প্রথমদিকে ভাইরাসটি মোকাবিলায় ও ঘোষিত লকডাউন কার্যকর করতে সরকারের মধ্যে সিরিয়াসনেস বা কঠোর মনোভাব পরিলক্ষিত না হওয়া। অর্থাৎ অফিস আদালত, দোকানপাট খোলা রেখে লকডাউন ঘোষণা দিয়ে লকডাউনকে তামাশায় পরিণত করা। যার কারণে জনগণ কোন সময়ই লকডাউনকে সিরিয়াসলি নেয়নি।

৫) বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্য-সম্মত বাসস্থানের অভাবও লকডাউন কার্যকর করার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। গুমোট গরম আবহাওয়ায় ঘিঞ্জি ঘরের কোণে কেউ আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না।

লকডাউন বলবৎ করতে না পারার বা না হওয়ার আরো কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে মোটা দাগে এগুলোই হলো প্রধান।

করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো। যে কোন যুদ্ধে জয়ের জন্য কয়েকটি শর্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ১) যথাসময়ে প্রস্তুতি গ্রহণ, ২) প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সকল শক্তিকে সন্নিবেশিত করা, ৩) দক্ষ সেনাপতি ও যোদ্ধা, ৪) শত্রু পক্ষ এবং নিজেকে পরিপূর্ণভাবে জানা এবং ৫) যুদ্ধ-ভূমি (terrain) সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা।

করোনা ভাইরাস নামক শত্রুর বিরুদ্ধে জিততে হলে সরকারকে উপরোক্ত পাঁচটি শর্ত হিসেব করেই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। যে কোন যুদ্ধে বিজয়ের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার অনিবার্য। সরকার এবং জনগণকে তার জন্য অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More