কল্পনা অপহরণ : গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এখনো একটি ‘দুষ্ট ক্ষত’

0

।। প্রসিত বি. খীসা।।
[ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার এই লেখাটি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অনিয়মিত প্রকাশনা পাহাড়ের রুদ্ধ কণ্ঠের দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। লেখাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে কল্পনা চাকমা অপহরণের ২০তম বার্ষিকী উপলক্ষে এখানে হুবহু প্রকাশ করা হলো –সম্পাদকমণ্ডলী]

# অপহৃত কল্পনা চাকমা। ফাইল ছবি
# কল্পনা চাকমা। ফাইল ছবি

(১)

পার্বত্য চট্টগ্রামে এটি এমন একটি বহুল আলোচিত ও সর্বজনবিদিত ঘটনা যে, এ প্রসঙ্গে কোন ভূমিকার অবতারণা না করে সরাসরি বলা যায়, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের এক সম্ভাবনাময়ী নেত্রী কল্পনা চাকমা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান সংঘটিত হবার প্রাক্কালে অপহৃত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের কারণে সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সে সময়কার দেশীয় পরিস্থিতিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার মতো কোন অরাজক বা গোলযোগপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। সারা দেশে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় তখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবচে’ কঠোর ও জোরদার ছিলো।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে সময় নিয়োজিত ছিলো সেনা-বিডিআর-পুলিশ-আর্মড পুলিশ-আনসার-ভিডিপি সহ রাষ্ট্রের সকল নিরাপত্তা সংস্থা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত খোদ নিরাপত্তা বাহিনীরই কতিপয় সদস্যের দ্বারা কল্পনা অপহরণের চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটে। সে কারণেই কল্পনা অপহরণ ঘটনাটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য–পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য আরো অনেক অপহরণ-খুন-গুম-হত্যাযজ্ঞ আর নারকীয় ঘটনার চাইতে অত্যধিক।

ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট বক্স ছিনতাই, ভোটারদের অস্ত্রের মুখে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান, ‘জাল ভোট’ দেয়ার চেষ্টা …সচরাচর দেশে নির্বাচনের ফলাফল নিজের পক্ষে আনার লক্ষ্যে যা দেখা যায়, কল্পনা সে ধরনের অনিয়মতান্ত্রিক কোন তৎপরতায় লিপ্ত ছিলো না।সাধারণ জনগণের উপর পরিচালিত নিপীড়ন নির্যাতনের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে সে হাতে অস্ত্রও তুলে নেয়নি।শ্রীলঙ্কা ও প্যালেষ্টাইনে প্রায়ই নিরাপত্তা বাহিনীর উপর যেভাবে সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালিত হয়ে থাকে, কল্পনা পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন সেনা ইউনিটের উপর সে ধরনের সশস্ত্র হামলাও করেনি।

কিন্তু কল্পনা ছিলো রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক প্রতিবাদী কন্ঠ। ভয়-ভীতি, হুমকী, প্রলোভন দেখিয়ে নিপীড়ক সেনা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি তাকে কখনই জব্দ করতে সক্ষম হয়নি। স্বভাবতই কল্পনা ছিলো কায়েমী স্বার্থবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির নিকট আতঙ্কের কারণ। তার সাথে রাজনৈতিক যুক্তি-বিশ্লেষণ ও অন্য কোন কিছুতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে, সেনা কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রটি এক ঘৃণ্য ন্যাক্কারজনক পন্থা অবলম্বন করে। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত অবস্থায়, কল্পনা নিজ বাড়ীতে নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্য দ্বারা অত্যন্ত কাপুরুষোচিতভাবে আক্রান্ত হয়। ঘটনাটি ঘটেছে ‘৯৬ সালের ১১ জুন মধ্য রাতে, ১:৩০-২:০০ টার সময়ে। আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী ১২ জুন, হিসেব করে দেখলে নির্বাচনের মাত্র ৭ ঘন্টা আগে।

কল্পনাদের পরিবারসহ গোটা নিউ লাল্যাঘোনাবাসী স্বাভাবিকভাবে তখন ছিলো গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মানুষের এমন দুর্বল সময়ে রীতিমতো দরজা কেটে দস্যু স্টাইলে বাড়ীতে ঢুকে আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় বৃদ্ধা মা, দু’ বড় ভাই ও বোৗ দি’র মাঝ থেকে লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্য কল্পনাকে বাড়ী থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। সে-থেকে কল্পনার হদিশ আজ অবধি মেলেনি। নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কল্পনাদের নিকটস্থ কজইছড়ি ক্যাম্পের কতিপয় সেনা সদস্য এ ঘটনা ঘটায়, যার নেতৃত্বে ছিলেন লেঃ ফেরদৌস নামের এক সেনা কর্মকর্তা।

অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিজ বাড়ীতে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত অবস্থায় কল্পনার মতো একজন নারী নেত্রী আক্রান্ত ও অপহৃত হবার ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের দুর্বলতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ফারাকটি সবার কাছে জাজ্জ্বল্যভাবে উম্মোচিত হয়েছে।

এ রাষ্ট্র, সরকার এবং এ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী, নিরাপত্তা ব্যবস্থা– দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তা, সমাজের প্রান্তিক-দুর্বল-অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠি এবং নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো দূরে থাক, উল্টো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকী হয়ে দাঁড়ায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় সংঘটিত এ যাবতকালের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে এর প্রমাণ মেলে।

(২)

অপহৃত কল্পনাকে উদ্ধার, তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ এবং চিহ্নিত অপহরণকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার দাবিতে সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। বর্তমানেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। দেশের বাইরেও কল্পনা অপহরণ ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে চিঠি দেয়।

প্রতি বছর ১২ জুন দিবসটিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে. যদিও তা আগের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে নয়।সরকারীভাবে না হলেও (যা আশা করা যায় না), লড়াই সংগ্রামে নিয়োজিত কর্মি তথা প্রতিবাদী জনগণের ক্যালেন্ডারে এটি ‘কল্পনা অপহরণ দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এখানে রূঢ় হলেও বলা দরকার যে,এক সময়ের কল্পনা অপহরণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আর আগের মতো এত ব্যাপক নয়। না হবার মূলে প্রধান কারণটিই হচ্ছে জনগণের মধ্যকার প্রতিবাদী শক্তির দ্বিধা বিভক্তি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ পরিস্থিতিতে কল্পনার অপহরণকারী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠিটিই লাভবান হচ্ছে।kalponachakma_rally_6w

এখানে লক্ষ্য করার বিষয়টি হচ্ছে, কল্পনা অপহরণ ঘটনায় স্পষ্টতঃই দু’টি ধারা সৃষ্টি হয়। একটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সূচিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চালিকা শক্তি তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন–পাহাড়ি গণপরিষদ (পিজিপি)-পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ)’এর সম্মিলিত প্রতিবাদ বিক্ষোভ।এ ধারার সাথে যুক্ত হয় দেশের প্রগতিশীল, উদার নৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং গণতান্ত্রিক সংগঠন সমূহ। এই সম্মিলিত প্রতিবাদ হচ্ছে দেশের বিবেকের প্রতিধ্বনি। এটি পাহাড় ও সমতলের সাধারণ জনগণের মধ্যে সমভাবে অন্যায়-অত্যাচার-শোষণ ও বৈষম্য বিরোধী অভিন্ন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃত প্রস্তাবে পাহাড়ি এবং বাঙালী জনগণের ঐক্য সূত্র গাঁথার এটিই হচ্ছে সঠিক পদ্ধতি। এ ধারাটি কল্পনাকে উদ্ধার, তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও চিহ্নিত অপহরণকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার দাবি জানিয়েছিলো। যা অত্যন্ত ন্যয় সঙ্গত,যৌক্তিক ও গণতান্ত্রিক দাবি। উদার নৈতিক, মানবতাবাদী ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন দেশের যে কোন নাগরিকই এ দাবির সাথে একাত্ম।

অন্যদিকে, এর বিপরীতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তাদের তৎপরতা বেশ লক্ষ্য করার মতো।অপহরণ ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে চিহ্নিত অপরাধী ও দুষ্কৃতকারীকে রক্ষা করার মতলবে এ চক্রটি নানান ষড়যন্ত্র চক্রান্তে লিপ্ত হয় এবং ন্যাক্কারজনক অপপ্রচারনায় মেতে উঠে। এ ঘৃণ্য অপকর্ম ও অপতৎপরতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে নিযুক্ত সেনা কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রের সাথে যুক্ত হয় দেশের চরম প্রতিক্রিয়াশীল, উগ্র সাম্প্রদায়িক,ভাড়া খাটা গবেষক, সাইনবোর্ড সর্বস্ব সংগঠন-গোষ্ঠি ও সমাজের অধঃপতিত, নীতি ও নৈতিকতাবর্জিত, ভ্রষ্ট,সব ধরনের সুযোগ সন্ধানী, উচ্ছন্নে যাওয়া দেউলিয়া প্রকৃতির টাউট-বাটপাড় ধান্দাবাজদের সম্মিলিত চক্র।শহরবাসীদের সকল বর্জ্য সিটি কর্পোরেশনের ডাষ্টবিনে জমা হবার মতো এ চক্রটির সাথে সমাজের সকল ভ্রষ্ট-পতিত ও সুযোগসন্ধানী ধান্দাবাজরা জড়িয়ে পড়ে। এ ধারাটি হলো দেশের চরম প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী, নীতিহীন, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মধ্যযুগীয় ধারার প্রতিনিধি।

এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটি চিহ্নিত অপহরণকারীর অপরাধ আড়াল করতে সে সময় পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন “নাটক” মঞ্চস্থ করে। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নানান অপতৎপরতা চালায়। কখনো সাইনবোর্ড সর্বস্ব তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক অপহৃত কল্পনার সন্ধান লাভ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতো জায়গায় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন, কল্পিত যুবকের হাত ধরে গৃহ থেকে “অন্তর্ধানকারী” কল্পনার ত্রিপুরা রাজ্যের এক গন্ডগ্রামে “ঘর-সংসার” করার গল্প ফেঁদে বসে ঐ তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাটি।

অন্যদিকে, কল্পনাকে কখনো বা এক “অভিমানী” তরুণী হিসেবে চিত্রিত করে তার উদ্দেশ্যে হৃদয়াবেগ উদ্বেলিত সস্তা দরের ‘গান রচনা’–যা প্রকারান্তরে তার প্রতিবাদী চরিত্র মুছে দেয়ার অপচেষ্টা বৈ কিছু নয়,কখনো রীতিমতো শহীদ বানিয়ে কল্পনার স্মরণে ভাড়া-খাটা চিহ্নিত গবেষকদের ‘সংকলন’ উৎসর্গ, আবার কখনো তার স্মরণে কোন কোন গোষ্ঠির বিশেষ ‘সংকলন’ ‘প্রকাশনা’ নিবেদন– এসব কর্মকান্ড আরো বেশী উদ্বেগজনক, এক কথায় ভয়ানক ক্ষতিকর।

শ্রদ্ধা নিবেদনের নামে মূল ঘটনা ধামাচাপা দেয়া এবং আন্দোলনের প্রতিবাদী চেতনা দুর্বল করার লক্ষ্যে এসব হচ্ছে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ, চিহ্নিত অপহরণকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার দাবিতে জোরদার আন্দোলন প্রশমিত হয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের নিছক কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে যাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে,সে উদ্দেশ্যে এসব পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে। কল্পনা অপহরণ ঘটনাকে “অন্তর্ধান” হিসেবে চালু করার মধ্যেও একই উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল। অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সূক্ষ্মভাবে শাসক চক্র এসব কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।অনেকে না বুঝে, সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র ঠাহর করতে না পেরে, এসব জাতীয় স্বার্থবিরোধী অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে এবং গণশত্রুতে পরিণত হয়। আবার সুযোগ সন্ধানী ধান্দাবাজরা জেনে-শুনে ব্যক্তি স্বার্থোদ্ধারের মতলবে স্বেচ্ছায় এ ধরনের ঘৃণ্য অপকর্মে যুক্ত হয়।

কল্পনা ইস্যুটি যেহেতু বহুল আলোচিত এবং দেশে জনগণের বিবেকে নাড়া দেয়া ঘটনার একটি, কাজেই সুযোগ সন্ধানী ধান্দাবাজরা (পাহাড়ি-বাঙালী উভয়ই) এ থেকে ব্যক্তিগত ফায়দা লুটতে ভীষণ বেশ তৎপর।অপহৃত কল্পনার ইস্যুটিকে উপলক্ষ বানিয়ে সাধারণ লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ, ব্যক্তিগত নাম-অস্তিত্ব জাহির,সস্তা দরের বাহ্‌বা-সহানুভূতি কুড়ানোর হীনপ্রবণতাও অত্যন্ত দৃষ্টি কটুভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক ব-কলম মার্কা লোকও এ বিষয়ে পত্রিকার পাতায় টেনে-টুনে দু’এক কলাম ভরাট করে (যার অধিকাংশই ব্যক্তিগত কাসুন্দি ও অপাঠ্য) মানবতাবাদী (?) ও সংগ্রামী সেজেছে। এ দেশে এমনই আকাল পড়েছে যে, এখানে অন্য অনেক সংকটের মধ্যে লোকের রুচিবোধের দুর্ভিক্ষও প্রকট! বাস্তবিক বলতে গেলে সমাজের এ অংশে পঁচন ধরেছে, এখন স্বাভাবিকভাবে পঁচা বাসির উপর আবর্জনা থেকে কালো ভনভনে মাছি উড়ে এসে বসছে! পত্র-পত্রিকায় এ ব-কলম মার্কাদের উৎপাতই পঁচনের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।

(৩)

বাঙালীদের মধ্যকার শোষক-নিপীড়নকারী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠির সাথে পাহাড়িদের মধ্যকার আপোষকামী-সুবিধাবাদী-প্রতিক্রিয়াশীল ধারাটির যোগসাজশের ঘটনাই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে একটি বড় দুঘর্টনা! পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনের বর্তমান সংকটকে বোঝার জন্য অবশ্যই এ বিশেষ দিকটির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা দরকার।

‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদন ও আত্মসমর্পণের পর, এক সময়ের জনগণের পক্ষে আন্দোলন পরিচালনাকারী সংগঠন জনসংহতি সমিতি কল্পনা অপহরণ ইস্যুতে সবাইকে অবাক করে দেশের চরম প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী স্বার্থবাদী সংঘবদ্ধ চক্রের এই দ্বিতীয় ধারাটির কক্ষপথে নিক্ষিপ্ত হয়। সমিতির কার্যকলাপ অনেক ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সাথে রীতিমতো শত্রুতার মতো হয়ে যায়। কল্পনা অপহরণের মতো একটি জঘন্য নিন্দনীয় ঘটনাকে সন্তু লারমা কর্তৃক “বিতর্কীত” আখ্যা দেয়ার মধ্যে তা নগ্নভাবে প্রকাশ পায় (১০ ফেব্রুয়ারি ‘৯৮, খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আত্মসমর্পণকালে দেয়া সাক্ষাতকার)। যা প্রকারান্তরে সেনা কায়েমী স্বাথবাদী সংঘবদ্ধ চক্রটির অপপ্রচারনার সাথে সুর মিলানোর সামিল।

পরিহাসের বিষয় হলো, একদিকে জনসংহতি সমিতির প্রধান কর্তৃক কল্পনা অপহরণকে “বিতর্কীত” আখ্যা দিয়ে সন্দেহ প্রকাশ, অন্যদিকে সমিতির মদদপুষ্ট কতিপয় সংগঠনের উদ্যোগে কল্পনার স্মরণে কখনো সখনো বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠানের আয়োজন, বিশেষ সংকলন প্রকাশ, ‘গান রচনা’, কতিপয় গবেষক কর্তৃক কল্পনাকে রীতিমতো শহীদ বানিয়ে বিশেষ সংকলন (বিপন্ন ভূমিজ : অস্তিত্বের সংকটে আদিবাসী সমাজ, প্রকাশকাল ২০০৩ এপ্রিল) উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা নিবেদন…এতে রীতিমতো পরষ্পর বিরোধিতাই প্রকাশ পায়। জনসংহতি সমিতি ও তার মদদপুষ্ট সংগঠন সমূহ কল্পনা অপহরণকে কিভাবে দেখছে, তা এক কথায় বিভ্রান্তিকর।

জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা দিয়ে সংগঠনের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়নি। সমিতির প্রধান আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য প্রকাশ্যে জনসমক্ষে দুঃখ প্রকাশ করেননি, কল্পনার বৃদ্ধা মা’র কাছেও ক্ষমা চাননি। সঙ্গত কারণেই পর্যবেক্ষক মহলের কাছে এসব প্রশ্ন হিসেবেই রয়ে গেছে।

কল্পনা অপহরণের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এমনকি দেশের বাইরেও এত বিক্ষোভ আন্দোলন,রূপনের মতো স্কুল ছাত্রের আত্মবলিদান, সমর-সুকেশ ও মনোতোষের গুম হওয়া এবং এত লেখালেখি, এত প্রতিবাদ, নিন্দার ঝড় সত্ত্বেও অপহরণের তদন্ত রিপোর্ট আজ পর্যন্ত কোন সরকারই প্রকাশ করেনি। এ রকম একটি ঘটনা সরকার এত বছর ধামাচাপা দিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এর পেছনে অন্যান্য কারণ গুলোর মধ্যে বাঙালি কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রের সাথে পাহাড়িদের মধ্যকার কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠির যোগসাজশ অন্যতম।

(৪)

এখানে আরো দেখা দরকার, দেশে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নির্বাচনের দিনে অপহরণের মতো একটি গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা বাদ দিলে,বলতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিলো সর্বদলীয় সম্মতির ভিত্তিতে। দলীয় সরকারের বিপরীতে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর দেশবাসীর মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণেরও নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচার পাবার কিছুটা অন্তত:ভরসা ছিলো।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান দায়িত্বই ছিলো দেশে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা।তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে খোদ নির্বাচনের দিনে অপহরণের মতো এত বড় গুরুতর অপরাধ করা সত্ত্বেও, চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিগত ৯ বছরে তিনটি সরকারই কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি, বা নিতে পারেনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আওয়ামী লীগ এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার চিহ্নিত দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছে এমনটি জানা যায়নি। অপহরণের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ, এ ন্যুনতম আইনী কাজটুকু করতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান বিএনপি সরকারের অনীহা ও অক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়। এতেই সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সমূহের ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠির অবহেলা ও উপেক্ষা, এ রাষ্ট্র-সরকার-সেনাবাহিনী-আইন আদালতের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে পড়ে।

নির্বাচনী আইনের কঠোর বিধি প্রয়োগের প্রসঙ্গটি বাদ দিলেও, দেশের সাধারণ আইনে অপহরণের মতো একটি দন্ডনীয় অপরাধের বিরুদ্ধে (নারী অপহরণ হলে ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড) শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং অভিযুক্ত সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ– যা সে সময়ে অত্যন্ত জরুরী ছিলো, ন্যুনতম সেই আইনী পদক্ষেপটুকু পর্যন্ত সরকার বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে– এমন তথ্য জানা যায়নি। দেশের পত্র-পত্রিকায় সে রকম কোন তথ্য প্রকাশিত হয়নি। উপরন্তু অপরাধ ধামাচাপা দিতে পরবর্তীতে যেভাবে গোটা সেনাবাহিনী তৎপর হয়ে উঠে, তার ফলে বিষয়টির উপর মানুষের সন্দেহ আরো বেশী বদ্ধমূল হয়।

সামরিক হেলিকপ্টারে রাঙ্গামাটি সহ বেশ কিছু এলাকায় কল্পনা চাকমার সন্ধান চেয়ে লিফলেট বিলি, সন্ধান দাতার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা, সেনা সদরের আইএসপিআর থেকে বিবৃতি প্রকাশ, সাইনবোর্ড সর্বস্ব একটি মানবাধিকার সংস্থাকে দিয়ে ত্রিপুরার এক গন্ডগ্রামে কল্পনা চাকমার সন্ধান লাভ এবং সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশ, খোদ তৎকালীন সেনা প্রধান লেঃ জেনারেল মাহবুব কর্তৃক ঘটনাকে “হৃদয়ঘটিত” বলে মিথ্যা বিবৃতি দান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম সদস্য প্রফেসর ইউনুস কর্তৃক সেনা প্রধানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিবৃতিদান…আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ প্রশমিত করার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের সংঘবদ্ধ তৎপরতার প্রতি সচেতন যে কোন নাগরিকের মনেই সন্দেহ উদ্রেক করা স্বাভাবিক।

অপহরণের মতো গুরুতর দন্ডনীয় অপরাধ ধামাচাপা দেয়া, আলামত নষ্ট করা, পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি ও গুজব সৃষ্টি করা– দেশের আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য। এই সাধারণ বিষয়ে উর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের ধারণা থাকবে না এটা বিশ্বাস করা কঠিন। সাধারণ এক জুনিয়র পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তার অপরাধ আড়াল করতে গোটা সেনাবাহিনী যে কান্ডকারখানার আয়োজন করেছে, এতে পরবর্তীতে আরো অপহরণের মতো অপরাধ করতে সেনা সদস্যদের উৎসাহিত করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চিহ্নিত এক দাগী অপরাধী লেঃ ফেরদৌস’কে রক্ষা করতে গোটা সেনাবাহিনী থেকে যেভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাতে এও সন্দেহ দেখা দেয় যে, অপহরণ ঘটনাটি নিছক এক জুনিয়র অফিসারের কাজ ছিলো না, তা উর্ধ্বতন কর্মকতাদের নির্দেশেই হয়েছে। যা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নীল নক্সা অনুসারে প্রণীত। সে কারণে অপরাধীকে রক্ষা করা ও ঘটনা ধামাচাপা দিতে এত কিছুর আয়োজন আবশ্যক হয়ে পড়েছিলো। নাকি তা “সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি” বিষয়ে অত্যধিক সচেতন ও বিচলিত কতিপয় অতি উৎসাহী সেনা কর্মকর্তার উর্বর মস্তিষ্কজাত চিন্তার ফলশ্রুতিই সে সব ব্যয় বহুল কর্মকান্ড পরিচালিত হবার কারণ! সুষ্ঠু বস্তুনিষ্ট তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তবেই এসব প্রশ্নের সদুত্তর মিলতে পারে।

কল্পনা অপহরণের ঘটনায় বাংলদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যে দৃষ্টিকটু রকমের তৎপরতা চালানো হয়,তার ফলে প্রতিষ্ঠানটির কমান্ড কাঠামো ও কার্যক্রম প্রশ্নের সম্মুখীন। কল্পনার অপহরণকারীকে রক্ষা করতে সে সময়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যে যে কাজ কারবার পরিচালিত হয়েছে, তার উপরও একটি উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত হওয়া দরকার। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই সে তথ্য উদঘাটিত হওয়া প্রয়োজন এবং একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সেনাবাহিনীর জন্যও তার গুরুত্ব অত্যধিক।

লিফলেট ছাপানো (যা সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্য, এমনকি কোন কর্মকর্তার পক্ষেও সহজ কাজ নয়) এবং তা হেলিকপ্টারে বিলি করার মতো এমন ব্যয় বহুল কার্যক্রম পরিচালনা, ৫০ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা–সেনাবাহিনীর কোন কর্মকর্তার এক্তিয়ারে রয়েছে কিনা এ প্রশ্ন ম্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। সে সব কর্মকান্ড রাষ্ট্রের কোন বিধি বলে বা কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে পরিচালিত হয়েছে তা এখনো রহস্যাবৃত। যা দেশবাসী কোন দিন জানতে পারেনি। দেশে পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসলেও, বিষয়টি কখনই আলোচিত হয়নি। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে এটা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার যে, সে সব ব্যয় বহুল কার্যক্রমের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে “অখন্ডতা” ও “সার্বভৌমত্ব” রক্ষার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই, এসব কাজ কারবার সেনাবাহিনীর পেশাগত দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। এর ফলে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গোটা সেনাবাহিনীই দেশবাসীর কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন ও বিতর্কীত হয়ে পড়েছে। এতে স্পষ্টতই সেনাবাহিনী সদস্যদের আর্থিক অনিয়ম, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-শৃঙ্খলার লংঘনের দিকটি জনসমক্ষে উম্মোচিত হয়ে পড়ে।

মনে রাখা দরকার, কল্পনা অপহরণ ঘটনা আড়াল আর সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষার ধুয়ো তুলে যে ব্যয় বহুল কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিলো, তাতে ঘটনা ধামাচাপা পড়েনি। ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না’। চাকমা বাগধারায় কথাটি আরো পরিষ্কারভাবে বলা যায়,’মরা হাতি কুলা ঢেকে আড়াল করা যায় না’। সাইনবোর্ড সর্বস্ব তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাকে হেলিকপ্টারে বাঘাইছড়িতে কল্পনার বাড়ীতে নেয়া এবং ঐ সংস্থা কর্তৃক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কল্পনার সন্ধান লাভের কথা প্রকাশ, কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী কল্পনার সন্ধান লাভকারী সংস্থাকে সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা পুরষ্কার প্রদানের কোন সংবাদই জানা যায়নি। একটি মানবাধিকার সংস্থার সন্ধান লাভ সত্ত্বেও এসব অসঙ্গতি কারোরই দৃষ্টি এড়ায়নি।

এসব কর্মকান্ড চালিয়ে সেনা বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি কখনই উন্নত করা যায় না। তাতে কেবল কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সেনা কর্মকর্তার পকেট ভারী হতে পারে মাত্র। যা পেশাদার মনোভাবাপন্ন সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবার সম্ভাবনা কম।

বাংলাদেশে মিগ-২৯, ডেষ্ট্রয়ার, বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম এবং সাম্প্রতিক কালে গঠিত এলিট ফোর্সর্ যাব’এর জন্য অত্যাধুনিক আর্মার্ড কার ক্রয়ের অনিয়ম নিয়ে কথাবার্তা উঠেছে। মিগ-২৯ ক্রয়ে অনিয়মের ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৭০০ কোটি টাকা লোকসান হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অনিয়মের জন্য রীতিমতো বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে (ডেইলি ষ্টার ১২ ডিসেম্বর ২০০১)। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, চিহ্নিত অপহরণকারী লেঃ ফেরদৌস ও তার চক্রকে রক্ষা করতে যে প্রক্রিয়ায় সরকারী অর্থ তছরূপ হয়েছে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় না কেন?

পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিতভাবে সেনা শাসন জারি থাকার কারণে এখানে অনিয়ম ও দুর্নীতি হবার আশঙ্কা সবচে’ বেশী। এখানে নিযুক্ত অনেক সেনা কর্মকর্তার ব্যাপারে বহু গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের চেয়ে কায়েমী স্বার্থের সাথে যুক্ত হওয়া এবং অবৈধভাবে কাঠ পাচার, ব্যবসা, ঠিকাদারী সহ অনেক রকমের বেআইনী কাজে জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রটি বলতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিযুক্ত সেনা সদস্যদের নিকট উন্মুক্ত। সেনা কর্তৃপক্ষের কড়া সেন্সরশিপের ফাঁক গলিয়ে কখনো কখনো সেনা সদস্যদের এ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের সংবাদ মাঝে মধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যার বিস্তারিত বিবরণ দেবার অবকাশ এখানে নেই।

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দেশের কোন অঞ্চলে সেনা শাসন জারি থাকলে খোদ সেনা বাহিনীর মধ্যে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। এখানে প্রাসঙ্গিক কারণে উল্লেখ করা যেতে পারে, সামরিক শাসনের সুবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লেঃ জেনারেল নিয়াজী ঢাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরে ‘পান ব্যবসা’ সহ অন্য অনেক রকমের কুকর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন। আরো অনেক পাক সেনা কর্মকর্তার ভূমিকা ছিলো জঘন্য ও ন্যাক্কারজনক–হামিদুর রহমান রিপোর্ট ও পাক জেনারেলদের স্মৃতিচারণে যা বেরিয়ে এসেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত এ ধরনের কোন তদন্ত বা লেখালেখি হয়নি,হলে অনেক লোমহর্ষক তথ্য বেরুবে তাতে সন্দেহ নেই।

(৫)

কল্পনা অপহরণ ঘটনাটি অন্য অনেক ঘটনার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, এ ঘটনায় সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সমূহের ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠির মনোভাব, রাষ্ট্র-সরকার-আইন আদালত ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভিতরকার দুর্বলতা উম্মোচিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সামরিকায়িত হবার কারণে এখানে নিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা কতখানি নিয়ন্ত্রণহীন এবং জবাবদিহি বহির্ভূত কার্যক্রম চালাতে পারে, তা এ কল্পনা অপহরণ এবং উক্ত ঘটনা ধামাচাপা দেবার লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মকান্ড থেকে বুঝা যায়।

এ ঘটনা থেকে আরো প্রমাণিত হয়ে যে, সরকার, দেশের আইন আদালত এবং রাষ্ট্রের কোন বিধি বিধান– পার্বত্য চট্টগ্রামে নিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা তোয়াক্কা করছে না, নয়তো তাদের উপর আইন কার্যকর হতে পারে না। একটা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান খুঁটি সেনাবাহিনীর উপর যখন সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তখন তার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা এ দেশবাসীর রয়েছে।

“অখন্ডতা” ও “সার্বভৌমত্ব” রক্ষার জিগির তুলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাস্তবত: মৃগয়া ক্ষেত্র বানিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যকার কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রটি ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রয়াসী হয়েছে– এ আশঙ্কা দিন দিন জনমনে প্রবল হচ্ছে। সময় মতো এ চক্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে, তারা দেশে ‘ফ্রাঙ্কেইনষ্টাইনের দানব’ হয়ে আবির্ভূত হতে পারে।

কল্পনা অপহরণ ঘটনাটি রাষ্ট্রের এমন একটি বড় ক্ষত, যা সারিয়ে না তুললে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণের মন থেকে এ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দুর্বলতার ব্যাপারে কখনই সন্দেহ সংশয় দূর হবে না। দেশেও সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হবে না। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও চিহ্নিত অপহরণকারী লেঃ ফেরদৌস চক্রের সুষ্ঠু বিচারই হবে রাষ্ট্রের এ ক্ষতটি সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে উচিত পদক্ষেপ। #

১০ জুন ২০০৫
———————–

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More