কালশী বিহারি ক্যাম্পে হামলা ও হত্যাকাণ্ড তদন্তে গণতদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় কমিটি

0

সিএইচটিনিউজ.কম
Dhaka press conference,22 June 2014ঢাকা: কালশী বিহারি ক্যাম্পে হামলা ও হত্যাকাণ্ড তদন্তে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি গঠনের দাবি সহ ৯ দফা দাবি জানিয়েছে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় কমিটি।  আজ রবিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলন থেকে পল্লবীর কালশীস্থ কুর্মিটোলা ক্যাম্পে বসবাসকারী বিহারীদের উপর পুলিশ এবং ভাড়াটে গুন্ডাদের বিনা প্ররোচণায় বর্বর হামলার এবং গত ১৪ই জুন শনিবার ১০ থেকে ১১ জনকে নির্দয় হত্যার তীব্র নিন্দা জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত অপর দাবিগুলো হলো: পুলিশের উপস্থিতিতে সংঘটিত এ নৃশংস ঘটনার জন্য অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ (সাসপেন্ড) করে তদন্ত ও বিচার করা; কালশী ক্যাম্প নিবাসিদের উপর গুলি বর্ষণ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, গরম পানি প্রয়োগসহ বল প্রয়োগের যৌক্তিকতা তদন্ত করে দায়ী পুলিশ সদস্যদেরকে বিচারের আওতায় আনা; হামলায় অংশগ্রহণকারী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক সংসদ সদস্যকে অনতিবিলম্বে বিচারের আওতায় এনে দ্রুত যথাযথ শাস্তি প্রদান করা; নিখোঁজ আশিককে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেয়া; ক্যাম্প থেকে গ্রেফতারকৃত সকল বাসিন্দাকে নিঃশর্তে অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে, সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যহার করতে হবে এবং সকল ধরনের পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা; আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলিকে কালক্ষেপণ ব্যতিরেকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা; কালশী ক্যাম্পের বাসিন্দাদের জন্য অনতিবিলম্বে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও উপার্জনের পন্থা, শিশুদের বিদ্যালয় গমন নিশ্চিত করা এবং উর্দূভাষী বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী ২০০ থেকে ৩০০ পুলিশ সদস্যদের দ্বারা তারা আক্রান্ত হন। পুলিশ ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, টিয়ার শেল এবং গরম পানি দিয়ে সজ্জিত এবং তাদের সাথে ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ ভাড়াটে গুণ্ডা যাদের হাতে ছিল চাপাতি। এটি ছিল মূলত পুলিশ বাহিনীর ছত্রছায়ায় একটি সুপরিকল্পিত হামলা। যদিও গুন্ডা-পান্ডাদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি কয়েকজন স্থানীয় বিহারী তরুণদের  সাথে পটকা-আতশবাজি ফুটানোর বিষয়কে কেন্দ্র করে বচসায় লিপ্ত হয়, যা বাংলাদেশের সর্বত্র শবে-বরাতের একটি ঐতিহ্য, স্থানীয়রা নিশ্চিত যে এই বর্বরোচিত হামলা ও ঠান্ডা মাথায় বিহারী সম্প্রদায়ের এতজন মানুষকে খুনের পেছনে এই তুচ্ছ ঘটনা কোন কারণ হতে পারে না।

লিখিত বক্তব্যে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, পবিত্র শবে-বরাতের সকাল ৬টায় বন্দুক ও টিয়ার শেল নিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ পুলিশ সদস্য আর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার এবং গরম পানির ট্যাংকসহ কালশীর বস্তি এলাকায় এসে উপস্থিত হয়। পুলিশ রাস্তায় স্থানীয়দের ওপর নির্বিচারে বুলেট ও রাবার বুলেট ছুঁড়তে ছুঁড়তে অগ্রসর হয়। এই হামলায় বহু স্থানীয় অধিবাসী আহত হন যাঁদের অনেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। যখন লোকজন বাড়ী ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেন তখন পুলিশ বাড়ীর ছাদে উঠে জানালার ভেতর বন্দুক ঢুকিয়ে তাদেরকে গুলি করে। আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যেয়ে দেখেছি গাছপালায় বুলেটের চিহ্ন, মাদ্রাসার সীমানা প্রাচীর, দোকানপাটের স্টিলের শাটার, ঘরবাড়ির ইটের দেওয়াল ও দরজা-জানালা ইত্যাদি গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। বেশ কিছু নারী-পুরুষ তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছররা গুলির জখম আমাদেরকে দেখিয়েছেন। যেসব লোকজন ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। একজন বৃদ্ধ আমাদেরকে জানান যে কীভাবে তাঁর দুটো ছোট মেয়ে বাড়ী থেকে পালিয়ে যেয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, পুলিশের প্রাথমিক হামলার পর গুন্ডা-পান্ডারা চাপাতিসহ স্থানীয় লোকজন ও তাদের সম্পত্তির উপর হামলা চালায়। আমরা স্থানীয় একটি সেলুন এবং অন্যান্য দোকানের ক্ষত-বিক্ষত শাটার দেখেছি যার ওপর চাপাতির বর্বর আঘাতের চিহ্ন ছিল। পুলিশী হামলার পর গুণ্ডা-পাণ্ডারা স্থানীয়দের উপর আক্রমণ চালায়, আর তারপর পুলিশ আরেক দফা হামলা চালায়। এভাবে পুলিশ আর গুণ্ডাদের উপর্যুপরি হামলা চলে ক্যাম্পে অবস্থানরত পরিবারগুলোর উপরে। এসব হামলার পাশাপাশি হামলাকারীরা লুটপাটও চালায়। নিঃস্ব একজন নারী অভিযোগ করেছেন যে রাস্তার পাশে বাঁধা তার আয়ের একমাত্র সম্বল দুটি দুধেল ছাগল আক্রমণকারীরা নিয়ে গিয়েছে। গুন্ডারা বড় রাস্তার দুধারের দোকানপাটের উপর হামলা চালিয়ে ও মূল্যবান জিনিষপত্র লুট করে নিয়ে যায়। তারা বাড়ী বাড়ী ঢুকে আক্রমণ চালিয়ে জিনিষপত্র তছনছ করে, রিফ্রিজারেটর ও টেলিভিশন ধ্বংস করে, এমনকি বহুদিনের কষ্টর্জিত নগদ টাকা পয়সা ও সোনাদানাও লুট করে নিয়ে যায়। এক পর্যায় পুলিশ উনিশ বছর বয়সী তরুণ আশিককে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নির্মমভাবে মারধোর করে একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয়। সেই থেকে সে নিখোঁজ, তার আর কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর আশিকের বাড়ীতে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে বারুদ ছিটিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয় যার ফলে সেটি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সেই সময়ে সেই বাড়ীতে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ দশজন বাসিন্দা ছিলেন। একজন নারী সদস্য অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় কোনমতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, কিন্তু আগুনে পুড়ে বাকি নয়জনের মৃত্যু হয়। এভাবে গর্ভবতী নারীসহ মোট দশজন মারা যান। এই ঘটনায় দশটি বাড়ী পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এই অমানবিক ঘটনায় এগারো জনের মৃত্যু, নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব সদস্য কর্তৃক সাত জনকে হত্যা, ফেনীতে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা এবং অন্যান্য হত্যাকান্ড এবং গুম খুব অল্প বিরতির মধ্যে ঘটেছে। এসব ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার যে রাষ্ট্রীয় এবং সরকারী এজেন্ট, ক্ষমতাসীন সরকারে অবস্থানরত রাজনীতিবিদ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক নির্যাতনসহ ঠাণ্ডা মাথায় আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সাক্ষীদের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে যেসব হত্যাকা- এখন সংঘটিত হচ্ছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে এইসব কা-কারখানা আর অপরাধমূলক ধৃষ্টতার মাত্রা আগের যে কোন সময়ের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে এই অপরাধীদের সাজা দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে অপরাধীদের মধ্যে লাভের আশায় অপরাধ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ক্রমাগত চার ঘন্টাব্যাপী নিরস্ত্র জনগণের উপর এই সর্বশেষ গোলাগুলির ঘটনা, একজন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যাসহ উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাইরে থেকে ঘরে তালা লাগিয়ে দশজনকে পুড়িয়ে মারা একটি অভূতপূর্ব ঘটনা যা যুদ্ধ পরিস্থিতির সমতূল্য– যে ঘটনা আমাদের সামাজিক কাঠামোকে ছিন্নভিন্ন করে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আকমল হোসেন। উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, ডাঃ ফয়জুল হাকিম, এডভোকেট খালিদ হোসেন, ওমর তারেক চৌধুরী, হাসিবুর রহমান প্রমুখ।
———-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More