খাগড়াছড়িতে রমেল চাকমার স্মরণে শোকসভা : বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ও দোষীদের শাস্তি দাবি
খাগড়াছড়ি: “অবিলম্বে অন্যায় ধরপাকড়-নির্যাতনসহ রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধ কর” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে সেনা হেফাজতে রমেল চাকমার মৃত্যুর জন্য দায়ী নান্যাচর জোন কমান্ডার লেঃ কর্নেল বাহালুল আলম ও মেজর তানভীরের শাস্তি, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন ও রমেল চাকমার পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবিতে শোক সভা করেছে খাগড়াছড়ি রমেল চাকমা শোকসভা আয়োজন কমিটি।
আজ শুক্রবার (১২ই মে ২০১৭) বিকাল ৩টার সময় স্বনির্ভর বাজারের চৌরাস্তার মোড়ে উক্ত শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পানছড়ি ১নং লোগাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রত্যুত্তর চাকমার পরিচালনায় খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চঞ্চুমণি চাকমার সভাপতিত্বে আয়োজিত শোক সভায় বক্তব্য রাখেন, পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বত্তম চাকমা, লক্ষীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা, গুইমারা উপজেলা চেয়ারম্যান উশ্যে প্রু মারমা, নানিয়াচর ৩নং বুড়িঘাট ইউপি সদস্য অংশাপ্রু মারমা, ২নং দুল্যাতলি ইউপি চেয়ারম্যান ত্রিলন চাকমা, শহীদ রমেল চাকমার পরিবারের পরিবারের পক্ষথেকে লাভলি চাকমা, শহীদ রমেল চাকমার বন্ধু রিপন চাকমা ।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ৪নং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তপন বিকাশ ত্রিপুরা।
সভা শুরুতে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে যেয়ে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মরেণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
শোকসভাকে কেন্দ্র দিনভর সেনাবাহিনীর তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। সকাল পৌনে ৮টার দিকে ৭টি সেনা জীপে করে ইউপিডিএফ কার্যালয় ও স্বনির্ভর এলকায় টহল দিতে থাকে। সকাল থেকে স্বনির্ভর এলাকায় দু’দিকে জেলা পরিষদ এর সামনে সড়ক এবং স্টেডিয়াম সম্মুখ সড়কে অস্থায়ী চেকপোস্ট বসায় সেনাবাহিনী। এসব চেকপোস্টে সারাদিন হয়রানিমূলক তল্লাসি চালানো হয়। এছাড়া যানবাহন চলাচলেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ব্যাপক সেনা তৎপরতার মধ্যেও বিভিন্ন উপায় বেড় করে শত শত নারী পুরুষ স্বতঃষ্ফুর্তভাবে শোক সভায় অংশগ্রহণ করেন।
শোক সভায় খাগাড়াছড়ি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমণি চাকমা বলেন, নানিয়ারচর জোন কমান্ডার লেঃ কর্নেল মোঃ বাহালুল আলম ও মেজর তানভীরা শুধু রমেল চাকমাকে হত্যা করেনি তারা সমস্ত বাংলাদেশের বিবেককে হত্যা করেছেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের মায়ের বুকের সন্তানকে কেড়ে নিয়েছেন। তিনি সমাবেশ থেকে অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে রমেল চাকমাকে যারা অন্যায় ভাবে হত্যা করেছে তাদের শাস্তির দাবি জানান।
পানছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা বলেন, রমেল চাকমাকে যেভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা কয়েছে সেটা কখনো সভ্য সমাজ এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমর্থন যোগ্য নয়। তিনি যারা রমেল চাকমাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদেরকে অবিলম্বে বিচারের আওয়াতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি ও শহীদ রমেল পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানান।
তিনি বলেন, এই ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো যদি পূরণ করা না হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে উক্ত দাবিসমূহ পূরণে বাধ্য করলে তার পরিণতি কখনো শুভ হবে না।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের মা-বোনেরা কোনো জায়গায় নিরাপদ নয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, শুধু সাধারণ জনগণ নয় পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনীধিরাও নিরাপদ নয়। আমাদেরকে সারক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় কখন এসে যে ধরে নিয়ে যায়। আমরা পেপার-পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে দেখি রাতে-বিরাতে পাড়ায়-মহল্লায় হয়রানিমূলক তল্লাশি, রাস্তায় রাস্তায় চেক-পোষ্ট বসিয়ে জনসাধারণকে হয়রানি করা হচ্ছে।
আমরা বাংলাদেশকে যতই উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে দেখার কল্পনা করিনা কেন কিন্তু মনে রাখতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত রেখে কখনো আমরা সেই বাংলাদেশ গড়তে পারবো না। আমি এই সমাবেশ থেকে বলতে চাই, আমরা নিরাপদ, স্বাভাবিক ও সম্মানজনক মৃত্যু চায়, আমরা বাংলাদেশের মৌলিক অধিকার নিয়ে সম্মাজনকভাবে বাঁচতে চাই। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে, কার্বারী হিসেবে, হেডম্যান হিসেবে, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের সম্মান চাই। কোন অবস্থাতে আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করা যাবে না।
তিনি আরো বলেন, রমেল চাকমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা যদি রাষ্ট্রের আইনের কাজ হয়, সরকার যদি বলে রমেল চাকমাকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে হত্যা করা হয়েছে, তাহলে আমি উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে কোন প্রতিবাদ করবো না। আমার প্রশ্ন গোলাম আজম যদি যুদ্ধঅপরাধী হয়েও বাংলাদেশের নাগরীক হিসেবে যেই বিচার পেয়ে থাকেন তাহলে রমেল চাকমা কেন পাবেনা কেন?
লক্ষিছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা বলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে রমেল চাকমা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে । আইন যদি সবার জন্য সমান হয় তাহলে লেঃ কর্নেল বাহালুল ও মেজর তানভীরকেও অবশ্যই শাস্তি পাবে না কেন?
উশ্যে প্রু মারমা বলেন, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষসহ জনপ্রতিনীধি উপজেলা চেয়ারম্যানরা পর্যন্ত নিরাপদ না। রমেল চাকমা হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর থেকে শুরু করে শাহবাগ পর্যন্ত এগিয়েছে। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছি। যাদের নেতৃত্বে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে তারাই আজ অগণতান্ত্রিকভাবে শাসন ব্যবস্থা জারি রেখেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও নানিয়াচরের ১নং বুড়িঘাট ইউনিয়নের মেম্বার অংশাপ্রু মারমা ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে বলেন, রমেল চাকমা কোন অপরাধী ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে থানায় কোন মামলাও ছিলেন না। সে মারা যাওয়ার পর আমরা লাশ আনতে যাই। চট্টগ্রাম থেকে আনার পর বুড়িঘাট এলাকা থেকে সেনাবাহিনী লাশ কেড়ে নেয়। পরদিন লাশ পুড়ে ফেলা হয়। এসময় তারা আামকে জিম্মি করে রাখে। পরদিন আরো দুইজন গ্রামবাসীকে জোর করে ধরে নিয়ে আনে। আমাদেরকে দিয়ে লাশ পোড়ানো হয়। এসময় রমেল চাকমার পরিবারের কোন সদস্য কিংবা নিকটআত্মীয় কেউ উপস্থিত ছিলেন। লাশ পোড়ানোর সময় কোনও প্রকার সামাজিক এবং ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলা হয়নি।
রমেল চাকমার নিকত্মাীয় লাভলী চাকমা অবিলম্বে হত্যাকারীদের বিচার দাবি জানান।
শোক সভায় খাগড়াছড়ি সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে জনপ্রতিনীধি, কার্বারী, হেডম্যান ও মুরুব্বী এবং স্কুল ছাত্র ছাত্রীসহ প্র্রায় ৬ শতাধিক অংশগ্রহণ করেন।
—————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।