বিশেষ রিপোর্ট
সিএইচটিনিউজ.কম
বিশেষ প্রতিনিধি: বাংলাদেশের নিপীড়িত-নির্যাতিন একটি অঞ্চলের নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানে আজো সেনাশাসন বলবৎ রাখা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের উপর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়ে আসছে। কাউখালী, লোগাং, নান্যাচর গণহত্যা সহ এ পর্যন্ত ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এই পার্বত্য চট্টগ্রামে। এছাড়া সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে আরো অসংখ্য।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত সাড়ে চার বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর ৮টি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ২টি, ২০১১ সালে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ৩টি, ২০১২ সালে রাঙামাটিতে ১টি এবং ২০১৩ সালে খাগড়াছড়িতে ২টি হামলার ঘটনা ঘটে। এখানে এসব হামলার সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হলো:২০১০ :
# ১৯-২০ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে পাহাড়িদের উপর সেনা-সেটলাররা সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। সেনারা সেটলারদের পক্ষ নিয়ে বেপরোয়াভাবে পাহাড়িদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে সেনাবাহিনীর গুলিতে লক্ষী বিজয় চাকমা ও বুদ্ধপুদি চাকমা নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়। সেটলারা পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বৌদ্ধ মন্দির সহ কমপক্ষে ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই করে দেয়।
# ২৩ ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি জেলা শহরে সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের গ্রাম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। তারা মহাজন পাড়া, সাতভাইয়া পাড়া, কলেজ পাড়া সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করে। এতে কমপক্ষে ৬৩টি বাড়ি ও দোকান পুড়ে ছাই করে দেয়া হয়।
২০১১ :# ১৭ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটির লংগদু উপজেলার গুলশাখালী ইউনিয়নের রঞ্জিত পাড়া ও বগাচদর ইউনিয়নের রাঙ্গী পাড়া এলাকায় সেটলাররা পাহাড়িদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এতে কমপক্ষে ২৩টি বাড়ি পুড়ে দেয়া হয়।
# ১৭ এপ্রিল সেটলাররা খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়, মানিকছড়ি ও গুইমারায় পাহাড়ি গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। সেটলাররা উত্তর শনখোলা পাড়া, সুলুডঙ পাড়া, রেম্রঙ পাড়া, তৈকর্মা পাড়া, পদাছড়া ও মানিকছড়ির মহামুনি পাড়ায অগ্নিসংযোগ করে একটি বৌদ্ধ বিহারসহ কমপক্ষে ৯৫টি বাড়ি পুড়ে ছাই করে দেয়। এছাড়া সেটলাররা জালিয়া পাড়ায় যাত্রীবাহী বাসে হামলা চালিয়ে বহু পাহাড়িকে আহত করে। এ ঘটনায় মিপ্রু মারমা নামের এক কিশোরী গুরুতর আহত হয় এবং আশীষ চাকমা নামে এক ছাত্র নিঁখোজ হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত আশীষ চাকমার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
# ১৪ ডিসেম্বর বাঘাইছড়ি সদর ও দিঘীনালা উপজেলার কবাখালীতে সেটলাররা পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। সেটলারদের হামলায় চিগোন মিলা চাকমা নিহত হয় এবং কমপক্ষে ১১জন পাহাড়ি আহত হয়। এক বাঙালি মোটর সাইকেল চালকের লাশ পাওয়াকে কেন্দ্র করে সেটলাররা এ হামলা চালায়।
২০১২ :২২-২৩ সেপ্টেম্বর পরিকল্পিতভাবে সেটলাররা রাঙামাটি শহরে পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। সেটলারদের হামলায় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, চিকিৎসক সহ কমপক্ষে শতাধিক পাহাড়ি আহত হয়। সেটলাররা পাহাড়িদের বেশ কয়েকটি দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পাহাড়ি চিকিৎসকদের চেম্বারে হামলা চালায় ও ব্যাপক ভাঙচুর করে। সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতেই সেটলাররা এ হামলা চালায়।
২০১৩ :# ২৫ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার হরিধন মগ পাড়া ও হেমঙ্গ পাড়ায় সেটলাররা হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এতে কমপক্ষে ২টি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং ৩৫টি বাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
# ৩ আগস্ট খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দংয়ে সেটলাররা পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ি গ্রামে হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এতে পাহাড়িদের ৩৫টি বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া সেটলাররা দু’টি বৌদ্ধ বিহার আক্রমণ করে। একটি বৌদ্ধ বিহারের দেশনা ঘর পুড়ে দেয়া সহ দু’টি বৌদ্ধ বিহারেই বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সেটলারা পাহাড়িদের ৪ শতাধিক বাড়িঘরে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। সেটলারদের হামলায় ১৩টি গ্রামের ৯ শতাধিক পাহাড়ি পরিবারের তিন সহস্রাধিক নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ পালিয়ে ভারতের সীমান্তে নো ম্যান্স ল্যান্ডে এবং পানছড়ি উপজেলাসহ আশে-পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এতে প্রত্যেক পরিবারই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উপরোক্ত হামলা ছাড়াও গত ৯ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের লামা উপজেলার রূপসী পাড়া ইউনিয়নের হ্লাসাই পাড়ার মুরুংঝিড়ি এলাকায় সেটলাররা পাহাড়িদের উপর হামলা চালিয়ে ১১ জনকে গুরুতর আহত করে এবং জুম ঘর ভেঙে দেয়। এর কয়েক মাস আগে নাইক্ষ্যছড়ি উপজেলার বাইশারী চাক পাড়া থেকে সেটলার ভূমি দস্যু কর্তৃক হামলার শিকার হয়ে ২২ পরিবার চাক নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়।অপরদিকে, গত ৩১ জুলাই গভীর রাতে সেটলারা “সন্ত্রাসী এসেছে, সন্ত্রাসী এসেছে” বলে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মাটিরাঙ্গার তাইন্দং বাজারে জড়ো হয় এবং পাহাড়ি-বিদ্বেষী উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিতে থাকে। এ সময় ভয়ে পার্শ্ববর্তী পাঁচটি পাহাড়ি গ্রাম হেডম্যান পাড়া, বগা পাড়া, পোমাং পাড়া, তানাকা পাড়া ও ৩ নং কলিন্দ্র কার্বারী পাড়া থেকে কয়েক শ’ পরিবার ভারতের সীমান্তে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
এর আগে ২ এপ্রিল মাটিরাঙ্গা উপজেলার প্রাণ কুমার পাড়ার দুর্জয় ত্রিপুরার বাড়িতে সেটলাররা হামলা চালায় এবং তাকে মারধর করে। এরপর ৫ এপ্রিল উক্ত গ্রামে দ্বিতীয় বারের মতো আবারো হামলা চালায়। এতে ১০ জন পাহাড়ি আহত হয় এবং ২৭ পাহাড়ি পরিবার ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।