ডেইলি স্টার থেকে

চিম্বুক গ্রাসের পর্যটন, কার উন্নয়ন? কীভাবে উন্নয়ন?

0

রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঈশানী চক্রবর্তী, শাহেদ কায়েস ও জোবাইদা নাসরীন


 

চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ ও উদ্যোগের প্রতিবাদে ম্রো জনগোষ্ঠীর কালচারাল শোডাউন

খুব সম্প্রতি সিকদার গ্রুপের (আর অ্যান্ড আর হোল্ডিং) বিরুদ্ধে ম্রো সম্প্রদায়ের ভূমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। গত ৮ নভেম্বর ২০২০ বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের কাপ্রুপাড়া এলাকায় কালচারাল শোডাউন ও সমাবেশ করেছে ম্রো জাতিসত্তার অসংখ্য নারী-পুরুষ। সেদিন ম্রোদের ঐতিহ্যবাহী বাঁশি বাজিয়ে, ব্যানার, পোস্টার নিয়ে এর বিরুদ্ধে চিম্বুক পাহাড়ের বেশ কয়েকটি গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ সমবেত হয়েছিলেন এবং প্রতিবাদ করেছিলেন। চিম্বুক ছাড়িয়ে কয়েক সপ্তাহ যাবত এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে সারা বাংলাদেশেই, আন্দোলন, প্রতিবাদ চলছে বিভিন্ন জায়গায়।

গত কয়েকদিন আগে প্রকাশ করা বান্দরবান জেলা পরিষদ এই বিষয়ে একটি বক্তব্য আমাদের নজরে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, তারা বাগান নয় পর্যটন করার জন্যই জায়গাটি লিজ নেন। কিন্তু, পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় জেলা পরিষদ প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে না পারায় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি একটি সংস্থাকে জমিটি ৪০ বছরের জন্য লিজ দেয়। তবে, ম্রো নেতারা বলছেন জেলা পরিষদ তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং বাগান করার জন্যই জেলা পরিষদ সেটি লিজ নিয়েছিল। কিন্তু, সেটি যে পরবর্তীতে অন্যকে  দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি ম্রো নেতাদের। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজেই বলছেন, অনুমোদনের জন্য ২০১২ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে পার্বত্য এলাকায় ভূমি বন্দোবস্ত কার্যক্রমে স্থগিতাদেশের শর্তাদি পূরণ না হওয়ায় মন্ত্রণালয় বন্দোবস্ত মামলাটি নিষ্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে জানায়। কারণ সেটিতে আঞ্চলিক পরিষদ এই লিজ বিষয়ে আপত্তি তোলে। ফলে জায়গাটি পরিষদের নামে বন্দোবস্ত গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন থেকে যায়। তাহলে জোরালো প্রশ্ন হলো যেখানে জেলা পরিষদের লিজ প্রক্রিয়াটিই ঝুলে ছিল, সেখানে কী প্রক্রিয়ায় এটি তাহলে জেলা পরিষদ অন্যকে দিলো? সেই অধিকার তাদের আছে কি না? এই বিষয়গুলো নিয়ে জেলা পরিষদের ‘কাঁই-কুঁই’মূলক সাংবাদিক সন্মেলনের বিপরীতে যৌক্তিক গ্রহণযোগ্য জবাবদিহিতা প্রয়োজন। এ ছাড়া, স্থানে স্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি-সম্বলিত পতাকা প্রস্তাবিত হোটেলের মধ্যে সেট করা হয়েছে, সেটাও তারা করতে পারেন কি না? এই প্রশ্নগুলো থেকেই যায়।

এরই মধ্যে গত ১৭ নভেম্বর সরেজমিনে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে আমাদের একটা টিম চিম্বুকের আশেপাশের গ্রামে গিয়েছিলাম। আমরা সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম সিকদার গ্রুপের উদ্যোগে পাঁচ তারকা হোটেল ‘ম্যারিওট’ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে গিয়ে আমরা দেখতে পেলাম কারবারির অফিস ঘর ভাঙা হয়েছে, সেই স্থান ছেড়ে দিয়ে অফিস ঘর দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন স্থানীয় কারবারি। যদিও জেলা পরিষদ দাবি করেছে সেই জায়গায় কেউ ছিল না। বর্তমানে পুরো এলাকা জুড়ে বাউন্ডারি দেওয়া হয়েছে। সেখানে পতাকার মতো করে ঝুলছে এই পাঁচতারকা হেটেলের প্রচারণা, সেই পতাকার মতো উড়তে থাকা প্লাকার্ডে আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাসৌজ্জ্বল ছবি। এর অনতিদূরেই একটি সাইন বোর্ড, যেখানে ‘Coming soon’ লেখা আছে, দুইটি হেলিপ্যাড নির্মাণসহ এই পর্যটন কেন্দ্রের প্রজেক্টের বিস্তারিত লেখা আছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেন তার কোনো প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করবেন? কারণ হলো মানুষকে ভীত রাখা। এই ছবি, সাইনবোর্ড দেখে মানুষ ভয় পাবে। ভাববে যখন স্বয়ং রা্ষ্ট্র এই প্রক্রিয়ায় জড়িত তখন সে আর কাছে তার প্রতিবাদ হাজির করবে। এরই মধ্যে জঙ্গল কাটা শুরু হয়েছে, গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরি হবে। এই নিয়ে চিম্বুক পাহাড়ের আশেপাশের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন এই ভেবে যে তার ঘরও ভাঙা হবে শিগগিরই। গ্রামবাসীর বক্তব্য ‘কেউ আমাদের সঙ্গে নাই, এমনকি রাষ্ট্রও আমাদের পক্ষে নাই।’

সূত্রমতে সেখানে শুধুই হোটেল নয়, আশেপাশের ১২টি পাহাড়ে পর্যটনকেন্দ্র করা হবে। ক্যাবল কারের (রোপ ওয়ে) মাধ্যমে একটা পাহাড়ের সঙ্গে আরেকটা পাহাড়ের সংযোগ স্থাপন করা হবে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়টি মাথায় রেখে ধারণা করা যায় যে, ভবিষ্যতে প্রায় ৭০ থেকে ১১৬টি পাড়ায় ৮০০ থেকে এক হাজার একর জমির মধ্যে বসবাসকারী প্রায় ১০ হাজার জুমচাষি উদ্বাস্তু হবে এবং তাদের জীবন-জীবিকা ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়বে। আমরা যখন কাপ্রুপাড়ায় যাই, সেই পাড়ার মানুষদের থেকে জানতে পারি ইতোমধ্যে সেই পাড়াগুলোর বুক চিরে হোটেলে যাওয়ার যে রাস্তা হবে সেটির মাপযোখ করা হয়েছে। এ থেকে সাদা চোখেই বোঝা যায় যে এই পাড়াগুলো আর ম্রোদের থাকবে না, কিংবা দু’চারটি পরিবার থাকবে যারা এই হোটেল কেন্দ্রিক পর্যটনের অংশ হবে। ‘এ ট্যুর টু এ ম্রো হাউস’ নামের ট্যুর প্যাকেজের অংশ থাকবে দু’চারটি ম্রো পরিবার।

এখানে এই হোটেল এবং রিসোর্ট নির্মিত হলে প্রাথমিকভাবে ম্রো জনগোষ্ঠীর চারটি গ্রাম- কাপ্রু পাড়া, কলাই পাড়া, দলা পাড়া ও এরা পাড়া (গ্রাম) উচ্ছেদ হবে। একই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে গ্রামগুলোর প্রায় ১৭৫টি পরিবার তাদের ভিটেমাটি হারাবে। পরবর্তীতে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। কারণ ধীরে ধীরে চিম্বুক পাহাড়ের পুরো বেল্ট-এর প্রায় সবগুলো গ্রামই চলে আসবে পর্যটনের আওতায় এবং কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই অঞ্চলে বসবাসকারী ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা।

আমরা যে দু’টো পাড়ায় গিয়েছি সেখানে দেখলাম বয়স্ক ম্রো নারীরা অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করছে। সেই অঞ্চলের আশেপাশে পানির উৎস নেই। বিদ্যুৎও নেই। কাপ্তাই নদীর বুক চিরে ১৯৫৯ সালে  বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হলো, কিন্তু পাহাড়ের এখনো ৫৭ শতাংশ অঞ্চল এই বিদ্যুতের বাইরে। নেই বাচ্চাদের পড়ার জন্য একটি সরকারি স্কুল। এসব মৌলিক অধিকার পূরণের ইচ্ছা নেই, স্বপ্ন নেই। কারো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু, চলছে সেখানে পর্যটনের নামে এই মানুষদের উচ্ছদের প্রক্রিয়া।

পাহাড়ে এই ধরনের একটি ম্যাগা প্রজেক্ট নির্মাণ প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এই বিষয়টাও কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীজুড়েই প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য চেষ্টা চলছে, সেখানে আমরা প্রকৃতি ধ্বংসের খেলায় উঠেপড়ে নেমেছি। এই পর্যটনকেন্দ্র নির্মিত হলে এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে, সেইসঙ্গে পাহাড়ের আদি সংস্কৃতিসহ সবকিছু বিপন্ন হয়ে যাবে।

বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়সহ নীলগীরির আশপাশের গ্রামে শত শত বছর ধরে বাস করছেন ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষজন। এই পাহাড় এ জাতিসত্তার জীবিকার প্রধান উৎস। চিম্বুক পাহাড়কে ঘিরে ম্রো জনগোষ্ঠীর মানুষদের জীবন-জীবিকা ধ্বংসের এই যে মাস্টার প্ল্যান, উপরে হেলিকপটার, নিচে পাহাড়িদের উপস্থাপন, পাহাড়ের জীব-বৈচিত্র্য, প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশের ‘ম্রো উপস্থাপনে’র রাজনীতি কোনোভাবেই এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের পক্ষে যায় না। পর্যটনকেন্দ্র নামে পাহাড়িদের জন্য মরণফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে, একে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলা যাবে না।

* লেখকরা রাজনীতিবিদ, কবি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

সূত্র: ডেইলি স্টার বাংলা

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More