টেকনাফে চাকমা পল্লীতে পুলিশ-ভূমি দস্যুর যৌথ হামলার তদন্ত ও বিচার দবি
নিজস্ব প্রতিবেদক
সিএইচটিনিউজ.কম
ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর সংগঠক মিঠুন চাকমা, চরণসিং তনচংগ্যা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রিনা দেওয়ান ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সদস্য নিলয় তনচংগ্যা গত ২৯ ও ৩০ মে টেকনাফের চাকমা পল্লীতে পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় স্থানীয় ভূমি দস্যু আবদুল হক ও তার দলবলের হামলা, লুটপাট, শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের বিচার বিভাগীয় তদন্ত, দোষীদের শাস্তি ও ক্ষতিগ্রস্তদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
গত ৪ ও ৫ জুন ঘটনাস্থলে তদন্ত শেষে তারা আজ ৭ জুন, বৃহস্পতিবারসরকারের কাছে উক্ত দাবি জানান। তারা টেকনাফে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা চাকমা জাতিসত্তার জমি বেদখল রোধ ও চাকমাদের জানমালের নিরপত্তা বিধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান।
হামলার উদ্দেশ্য ও ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তারা বলেন, হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চাকমাদের মালিকানাধীন জমি বেদখলের প্রচেষ্টা। স্থানীয় বিভিন্ন মহলের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভূমি দস্যু আব্দুল হক হোয়াইখয়ং ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা জাফর আলম চৗধুরীর সহায়তায় বহু বছর ধরে শুকনা আমতলী গ্রামের চিংপুঅঙ চাকমাসহ সাত ভাইয়ের ১০ একর জমি দখলে নেয়ার নানা পায়তারা চালিয়ে আসছে। এ নিয়ে উভয় পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা দায়ের করেছে। গত ১২ মে আব্দুল হক ও তার দলবল জোটবদ্ধ হয়ে উক্ত জমি দখলের চেষ্টা চালায়। তবে চাকমারা বাধা দিলে তারা ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ গত ২৯ মে রাতে সাদা পোষাকধারী দু‘জন পুলিশকে নিয়ে আব্দুল হকের লোকজন আমতলী গ্রামে যায়। তারা ভাক্তচিং চাকমা ও চিংকয়লাহ চাকমাকে পথে পেয়ে মারধর করতে থাকে। তাদের আর্ত চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন ডাকাত এসেছে ভেবে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে। এ সময় শিপন মিয়া নামে এক পুলিশ সদস্য এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সে নিজেকে পুলিশ সদস্য পরিচয় দিলে লোকজন সরে যায়। এর কয়েক ঘন্টা পর ভোর রাতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ এসে চাকমা পল্লীর বাড়ি বাড়ি তল্লাশী ও হামলা চালায়। তাদের সাথে আব্দুল হকের লোকজনও ছিলো বলে গ্রামবাসীরা অভিযোগ করে।
তদন্ত শেষে দেয়া বিবৃতিতে হামলার ফলাফল উল্লেখ করে তারা আরো বলেন, হামলায় মোট ১১ জন চাকমা আহত হয়। কয়েকজন নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়। উছাথোয়াইং চাকমা নামে ৭ – ৮ মাসের গর্ভবতী মহিলাকে নির্যাতন করা হলে তার সঙ্গে সঙ্গে গর্ভপাত হয়। তার স্বামীকে পুলিশ আটক করে। এ ছাড়া মালাইমে চাকমাকে কোমড়ে লাঠি মারলে তার প্রসব বেদনা শুরু হয় ও হাসপাতলে ভর্তি করা হলে সেখানে তার সন্তানের জন্ম হয়।
এছাড়া ১৮ বছরের যুবতী লাকি চাকমার কোমড়ে ও পায়ে আঘাত করা হয়। গৃহিনী উষাখেইং চাকমা (বয়স ৪৫) জানান তাকে হামলাকারীরা লাথি মারে। এ সময় তার সামনে ৮৫ বছরের বৃদ্ধা শ্বাশুরীকেও নির্যাতন করা হয়। তিনি তার শ্বাশুরীকে না মেরে তাকে মারার জন্য কাকুতি মিনতি করলে তবেই তারা রেহাই দেয়।
রিম্রাচাং চাকমা, ৫৫, বলেন ‘তারা আমাদের বাড়ীর দরজায় ধুমধাম লাথিপেটা করতে থাকলে আমি দরজা খুলে দিই। এরপর তারা আমাকে লাঠি দিয়ে পেটায়। হামলাকারীরা আমার ১৫ বছরের কিশোরী মেয়ে মায়মাচিং সুমিকেও নির্যাতন করে।‘ তদন্ত টিম সুমির শরীরের স্পর্শকাতর অংশ আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়।
হামলার সময় অর্থ লুটপাট, সম্পত্তির ধ্বংসসাধন ও বৌদ্ধমূর্তি অবমাননার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রিম্রাচাং চাকমা স্বামী- থোৎয়াইংচা চাকমা ইউপিডিএফের তদন্ত দলের কাছে অভিযোগ করে বলেন, তার বাড়ির অলমিরা ভেঙে ৮৫ হাজার টাকা লুট করা হয়, এছাড়া ১২ আনা সোনার চেইন, কানফুল, অংটি ও তার মেয়ের সিন্ধুক ভেঙে ৫ হাজার টাকা লুট করা হয়েছে।
এছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের ব্যবহৃত দা ও গাছ কাটার করাত যন্ত্র হামলাকারীরা নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অংকিউ চাকমা জানান, তাদের বাড়ির ৫ টি দা ও একটি করাত যন্ত্র নিয়ে যাওয়া হয়। থোয়াইনচা চাকমা জানান, তার ৭টি দা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঘরে একটি দা‘ও অবশিষ্ট নেই। মারি চাকমার (স্বামী কালাউ চাকমা) বাড়ি থেকে ৬ টি দা ও একটি করাতযন্ত্র হামলাকারীরা লুট করে নিয়ে যায়।
রিম্রাচাং চাকমা জানান আক্রমণকারীরা তার বাড়িতে ঢুকে বুদ্ধ মূর্তি রাখার আসন হতে বুদ্ধ মূর্তি মাটিতে ফেলে দেয়।
বেশ কয়েকটি বাড়ি ঘুরে তদন্ত টীম দেখেতে পায় বাড়িঘরের হাড়িপাতিল ভেঙে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
পুলিশ ৪ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে এখনো জেলে আটক রাখা হয়েছে। আটককৃতরা হলেন উষাখাইন চাকমা, সাত্রাক হোসাইং চাকমা, চাথোয়াইন চিং চাকমা ও অংজা চাকমা। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৩/৩৪১/২২৪/২২৫/১৮৬/৩৩২/৩৩৩/৩৫৩/৩০৭ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ ৩ জন বাঙালিকেও আটক করেছে। এরা হলেন মো: শফীক, হেলাল উদ্দীন ও কাদের হোসেন।
এলাকায় এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এলাকার লোকজন ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। রাত হলেই এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে যায়। আমতলী গ্রামে সাত জন প্রাইমারি ও হাই স্কুলের ছাত্র এখনো ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না।
এলাকর বিশিষ্ট ব্যক্তি মংভাগ্য চাকমা জানান এলাকায় বর্তমানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। কাজ করার লোকজন পালিয়ে থাকার কারণে চাষাবাদের কাজ চলছে না। ঝড়ের সময় ঘরবাড়ি মেরামতের লোকজনও পাওয়া যাচ্ছে না।
তদন্ত টীমের মূল্যায়ন ও দাবি:
১. তদন্ত টীম মনে করে প্রশাসন পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। ২৯ ও ৩০ মে আসামী ধরার নামে পুলিশ বাহিনী ভুমিদস্যু আব্দুল হকের দলবলসহ আমতলী গ্রামে যে হামলা চালানো হয়েছে তাতে পুলিশ ভূমিদস্যূদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। তদন্তটীম পুলিশের এ আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।
১. তদন্ত টীম মনে করে প্রশাসন পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। ২৯ ও ৩০ মে আসামী ধরার নামে পুলিশ বাহিনী ভুমিদস্যু আব্দুল হকের দলবলসহ আমতলী গ্রামে যে হামলা চালানো হয়েছে তাতে পুলিশ ভূমিদস্যূদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। তদন্তটীম পুলিশের এ আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।
২. তলাশীর নামে গ্রামে যে লুটপাট চালানো হয়েছে তাকে অতন্ত ঘৃন্য ও ন্যাক্কারজনক। ভুমিদস্যুদের সহায়তা নিয়ে গ্রামের চাকমা জনগণের প্রতি যে হামলা ও লুটপাট এবং নারীর শীলতাহানি হয়েছে তার সুষ্ঠু বিচার ও তদন্তপূর্বক দোষী পুলিশ সদস্য, আব্দুল হক ও তার দলবলের বিচার ও শাস্তি দাবি করছে।
৩. গ্রামের লোকজনের বিরুদ্ধে যে মামলা প্রদান করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও হয়রানীমূলক বলে তদন্তটীম মনে করে। গ্রামের লোকজনের বিরুদ্ধে করা সকল ধরণের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের জন্য তদন্ত টীম সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে। মামলার আসামী ধরার নামে লোকজনকে হয়রানী না করার জন্যও টীম দাবি জানাচ্ছে।
৪. টেকনাফ এলাকার চাকমা জাতিসত্তার লোকজন নানাভাবে প্রভাবশালী মহলের দ্বারা জমি হারাচ্ছে। দেখা গেছে এলাকার প্রভাবশালীরা মামলা-পুলিশী হয়রানী ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের ভূমি আত্মসাৎ করছে। চাকমা সম্প্রদায়ের ভূমি যাতে ছলচাতুরী করে ও জোরপূর্বক প্রভাবশালীরা কেড়ে নিতে না পারে তার জন্য প্রশাসনের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়াজন।
৫. চাকমা জাতিসত্তার জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।