শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা’র আত্মবলিদানের ২৫ বছর

দীঘিনালাতে স্মরণ সভা : তৎকালীন ছাত্র নেতাদের স্মৃতিচারণ!

0

দীঘিনালা : পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা’র আত্মবলিদানের ২৫ বছর পুর্তিতে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন-এর দীঘিনালা উপজেলা শাখার উদ্যোগে গতকাল ১৩ অক্টোবর দীঘিনালায় তাঁর নিজ গ্রাম বানছড়াতে এক স্মারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে তৎকালীন পিসিপি দীঘিনালা থানা শাখার আহ্বায়ক চয়ন চাকমাসহ বহু সাবেক ছাত্র নেতা, বানছড়া ও দীঘিলানার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আমন্ত্রিত ছাত্র-যুব-নারী ও গণমান্য ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন।

বেলা পৌনে ২টায় শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা’র নিজ গ্রাম বানছড়াতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) দীঘিনালা উপজেলা শাখার সভাপতি নিকেল চাকমা। এতে বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক মাইকেল চাকমা, পিসিপি’র কেন্দ্রীয়  সভাপতি বিনয়ন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের দীঘিনালা উপজেলা সভাপতি সজীব চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দীঘিনালা উপজেলা সভাপতি এন্টি চাকমা।

এছাড়া আরও বক্তব্য রাখেন ১৯৯২ সালের পিসিপি দীঘিনালা থানা কমিটির আহ্বায়ক ও ১৩ অক্টোবর ছাত্র-গণ সমাবেশ আয়োজক কমিটির অন্যতম প্রধান সংগঠক রিপন চাকমা (চয়ন) ও তৎকালীন ছাত্র নেতা জীব কান্তি চাকমা, কাতারুং মৌজার হেডম্যান চন্দ্রহংস ত্রিপুরা, জেএসএস-এর সাবেক সদস্য ও বাঘাইছড়ি মুখ গ্রামের অন্যতম মূরুব্বী কৃপা রঞ্জন চাকমা, পা: চ.নারী সংঘের সভাপতি মিকা চাকমা।

সভা পরিচালনা করেন পিসিপি দীঘিনালা থানা শাখার সাধারন সম্পাদক জীবন চাকমা।

ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেন, শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা জাতির এক মহান গৌরব এবং অহংকার। তিনি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা। তাঁর এই মহান আত্মবলিদান পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের মুক্তির দিশা দেখাবে। শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা ‘র নাম পার্বত্য চট্ট্রগামের  ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি যুগে যুগে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।

তিনি আরো বলেন, শহীদ ভরদ্বাজ মুনি’র  মহান আত্মবলিদান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। যে কোন কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র-যুবকদের প্রতি আহ্বাবান জানান।

পিসিপি কেন্দ্রীয় সভাপতি বিনয় চাকমা বলেন, শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা বৃদ্ধ বয়সেও ঘরে বসে থাকতে পারেননি। রাষ্টীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তিনি পিসিপি ও পিজিপি’র ডাকা সেদিনের সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে প্রথম শহীদ তিনি। শহীদ ভরদ্বাজ মুনি’র কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নতুন প্রজম্মকে সাহসী হয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে ছাত্র সমাজের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

স্মরণ সভায় ১৯৯২ সালের ১৩ অক্টোবর আয়োজিত সমাবেশের স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন পিসিপি দীঘিনালা থানা শাখার আহ্বাবায়ক রিপন চাকমা (চয়ন) বলেন, সে সময় সংগঠন করা এবং সমাবেশ আয়োজন করা সহজ ছিল না। তখন আমি সবে বিএসসি পাশ করেছিলাম। প্রথম যে কমিটি গঠন করা হয় সে কমিটিতে আমি আহ্বায়কের দায়িত্বে ছিলাম না। সে কমিটির নেতারা কমিটি গঠনের পরদিন সংগঠন থেকে ইস্তফা দেয়। ’৯২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা সরকারী স্কুল মাঠে বসে যে কমিটি গঠন করা হয় সে কমিটিতে আমাকে আহ্বায়কের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়।

তৎকালীন সময়ে দীঘিনালাতে সেনা মদদপুষ্ট চর ও স্পাইদের ব্যাপক তৎপরতা ছিল। পরে মুখোশ বাহিনী, গপ্রক বাহিনী ইত্যাদি নাম দিয়ে আন্দোলন বিরোধী তৎপরতা চালায়। এর বিরুদ্ধেই ছিল ১৩ অক্টোবরের ছাত্র-গণ সমাবেশ। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার এবং সপ্তাহিক হাটের দিন। সে সমাবেশে শত শত ছাত্র-জনতা সাহসের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ৭০ বছরের বয়োবৃদ্ধ শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা। সমাবেশে পরিকল্পিতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি হামলা চালালে ঘটনাস্থলে তিনি শহীদ হন। তিনি শহীদ ভরদ্বাজ মুনির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানান।

তৎকালীন আরেক ছাত্র নেতা জীব কান্তি চাকমা ১৩ অক্টোবরের ঘটনা স্মরণ করে বলেন, ১৯৯২ সালে পিসিপি দীঘিনালা কমিটি গঠনের পর আমরা স্থানীয়ভাবে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সমাবেশ করার জোর তাগিদ অনুভব করি। পরে ১৩ অক্টোবর গণসমাবেশের সিদ্ধান্ত হয়। তৎকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মাত্র চরম আকার ধারণ করেছিল। বাজার থেকে সেনাবাহিনী প্রদত্ত বিশেষ কার্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমান চাল, ডাল, তেল, লবন, ম্যাচসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হতো। বিভিন্ন জায়গায় সেনা চেকপোষ্ট বসানো ছিল। সেসব চেকপোষ্টে কারণে অকারণে মালামাল তল্লাসির নামে জনগণকে হয়রানি করা হতো। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে সেনা মদদপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে এর বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষুদ্ধ ছিল। এসব কারণে পিসিপি ও গণ পরিষদের ডাকা সেদিনের সমাবেশটি ছাত্র-যুবকদের ছাড়াও সকল বয়সীদের নিকট সাড়া জাগিয়েছিল। প্রত্যন্ত বানছড়া গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ ভরদ্বাজ মুনি চাকমাও বসে থাকতে পারেন নি। প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন গণ সমাবেশে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের আক্রমনে তিনি সেদিন শহীদ হয়েছেন। তিনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

সাবেক জেএসএস সদস্য ও বাঘাইছড়ি মুখ গ্রামের মূরুব্বী কৃপারঞ্জন চাকমা বলেন, জেএসএস-এর বহু কর্মী শহীদ হয়েছেন। তাঁদেরকে নিয়ে এভাবে স্মরণ সভা আয়োজন করতে কখনো দেখিনি। শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা আমাদের গৌরব। এ সভা আমাকে অনুপ্রাণিত করছে।

সভার শুরুতে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এছাড়া স্মরণ সভার পাশাপাশি সে সময়কার আন্দোলনের বহু দুর্লভ ছবি নিয়ে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
__________
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More