পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন: আশির্বাদ না অভিশাপ?

0

।। আর এস ত্রিপুরা ।।

বিশ্বে আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জাতির উপর পর্যটনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা ও বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নতির কারণে পর্যটন শিল্পের প্রসার নিরন্তর ঘটে চলেছে। আধুনিক পর্যটন, – যা উন্নত দেশগুলোতে জনগণের সকল শ্রেণীর কাছে ক্রমবর্ধমান হারে সহজ লভ্য হচ্ছে,- তার সূচনা হয় প্রধানত মোটরযান, প্রশস্ত রাস্তাঘাট ও হাইওয়ের উন্নতির ফলে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের মধ্যেই কমার্শিয়াল জেট বিমান চালু হওয়ায় আন্তর্জাতিক ভ্রমণ দ্রুততর হয় এবং পর্যটন শিল্পের বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৭০ দশকের মধ্যে জেট বিমানের উন্নতির ফলে পর্যটনের জন্য বিশ্বের দুয়ার খুলে যায়।[১] এ কারণে অনেকে পর্যটনকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প (industry) হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[২]

নাগরিক জীবনের এক ঘেঁয়েমি, শারীরিক ও মানসিক চাপ থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার আশায় অনেকে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন, চলে যেতে চান নৈসর্গিক প্রকৃতির কোলে। আর আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে প্রকৃতির দেখা মেলে প্রধানত আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জাতিগুলোর আবাসভূমিতে। ফলে ইদানিং ethnic tourism, tribal tourism, eco tourism -এর কথা ব্যাপকভাবে শোনা যায়। এখানেই পর্যটনকে ঘিরে আমরা দেখতে পাই সভ্য দুনিয়ার সাথে প্রকৃতির সংযোগ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া।

# “নীলগিরি” বান্দরবান। সেনাবাহিনী কর্তৃক এই পর্যটন গড়ে তোলার কারণে ম্রো জাতিসত্তার লোকজন উচ্ছেদের শিকার হয়। ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রামেও সড়ক ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি এবং দেশে মধ্য বিত্ত শ্রেণীর বিকাশের কারণে পর্যটন শিল্পের দ্রুত বিকাশ হতে শুরু করেছে। কিন্তু পর্যটন সংখ্যালঘু পাহাড়ি জাতিগুলোর আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর কী প্রভাব সৃষ্টি করছে, কারা এই প্রসারমান শিল্প থেকে লাভবান হচ্ছে, সে সম্পর্কে আজো বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। লেখকের বর্তমান নিবন্ধটিও কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিগত গবেষণার ফল নয়। সম্প্রতি সরকার কর্তৃক খাগড়াছড়ির আলুটিলায় একটি বিশেষ পর্যটন জোন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে জনগণের সংগঠিত প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে পর্যটন ইস্যুটি সামনে চলে আসে। এই নিবন্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু জাতি বা আদিবাসীদের উপর পর্যটনের প্রভাবের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে এর ক্ষতিকর দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে পর্যটন বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্ককে উস্কে দেয়ার প্রয়াস করা হয়েছে।

কতিপয় দৃষ্টান্ত
পর্যটন প্রায়শ স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ এবং তাদের সাথে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করে। ইতিহাসে সংখ্যালঘু জাতি বা আদিবাসীদের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের দৃষ্টান্ত ভরপুর। মালয়েশিয়ার পেনাঙ-এ এবং থাইল্যান্ডের ফুকেট-এ পর্যটনের জন্য সৈকত হোটেল নির্মাণের ফলে সেখানকার মৎস্য সম্প্রদায় উচ্ছেদের শিকার হয়। কানাডায় মোহকদের (Mohawk) কবর স্থানে গলফ মাঠ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গণ বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ায় দ্বীপে ও ইন্দোনেশিয়ার বালিতে পর্যটন ‘রিসোর্ট’ নির্মাণের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতির কবর স্থানের পরিহানি ঘটানো হয়। আমাজানের গহীন জঙ্গলে অসংবেদনশীল পর্যটন মালিকরা স্থানীয়দের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিঘ্ন ঘটায় এবং আদিবাসীদের মধ্যে টিউবারকিউলোসিস বা ক্ষয় রোগের মতো মারাত্মক পীড়া নিয়ে আসে।[৩]

একশত বছরের অধিক সময় ধরে আমেরিকায় রক্ষিত এলাকা অভয়ারণ্য ও ন্যাশনাল পার্ক সৃষ্টির ফলে আদিবাসী জনগণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। যে জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে জমিতে বসবাস করেন ও যে জমি তারা সংরক্ষণ করেন সেখান থেকে তাদের উৎখাত করা হয়। এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্তের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য। ক্যানিয়ন নামক এলাকায় সংখ্যালঘু হ্যাভাসুপাইদের বসবাস। যুক্তরাষ্ট্রে সকল সংখ্যালঘু জাতি বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো তারাও ট্যুরিজম বা পর্যটনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদেরকে নিজ এলাকা থেকে উচ্ছেদ করে তাদের বংশ পরম্পরার জমির একটি ক্ষুদ্র অংশে জায়গা দেয়া হয়। ১৯১৯ সাল নাগাদ গ্রান্ড ন্যাশনাল ক্যানিয়ন পার্ক গঠনের ফলে তাদের এলাকা মাত্র ৫১৮ একরের মধ্যে সীমিত হয়ে যায়। এ সময় হ্যাভাসুপাইদের ধরে ধরে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়। তাদের বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন বিভাগ তাদের পানির কূপগুলো ভরাট করে দেয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অনেকে মারা যান। বহু বছর ব্যাপী আইনী লড়াইয়ের পর ১৯৭৪ সালে হ্যাভাসুপাইরা তাদের পূর্বতন জমির কিছু অংশ ফিরে পায়। গ্রান্ড ক্যানিয়নে প্রতি বছর ৪০ লক্ষ দর্শণার্থী আসেন। তাদের একটি অংশ ২০,০০০ দর্শনার্থী হ্যাভাসুপাইদের সংরক্ষিত এলাকায় যান। এজন্য প্রতি দর্শনার্থীকে ১৫ ডলার দিতে হয়। এ অর্থ হ্যাভাসুপাইদের তহবিলে যোগ হয় এবং তা তাদের পুরো সম্প্রদায়ের জন্য খরচ করা হয়। পর্যটন এভাবে হ্যাভাসুপাইদেরকে চিড়িয়াখানার জন্তুর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এখনো তাদেরকে পর্যটনের তীব্র প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। হেলিকপ্টার ও বিমান থেকে সৃষ্ট শব্দ দূষণ, আবর্জনা, ভূমিক্ষয়, বন্য প্রাণীর সঙ্গীন অবস্থা ইত্যাদি হলো বর্তমানে তাদের এলাকার পর্যটনের নেতিবাচক ফল।[৪]

তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা
জু-মিং লি এবং দউ-জাইয়ি লু নামে দুই গবেষক তাইওয়ানের অর্কিড দ্বীপে (Orchid Island) তাও জাতিসত্তার উপর পর্যটনের প্রভাব সম্পর্কে গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে তাওদের ধর্ম-বিশ্বাস বা কুসংস্কার ও সামাজিক আচার প্রথা, সংস্কৃতি বন্য প্রাণী সংরক্ষণে ভূমিকা রেখেছে এবং পর্যটনের প্রভাবে সে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে এবং সে সব বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। তারা লেখেন, অর্কিড দ্বীপের প্রাণ-পরিবেশ ও তাও জাতিসত্তার সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে হয়, এক শ্রেণীর পেঁচা, প্রজাপতি ও কাঁকড়া তাইওয়ানের এই তিন প্রজাতির সংরক্ষিত বন্য প্রাণীর উপর পর্যটনের প্রভাব তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট। এই তিন প্রাণী তাও জাতিসত্তার সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং তারা ঐতিহ্যগত প্রাণ সম্পদের নির্দেশক। শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সংস্কারের কারণে তাও জাতিসত্তার লোকজন এই প্রাণীগুলোকে শিকার বা সংগ্রহ করে না। এই তিন প্রজাতির প্রাণীগুলোর সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের এখন সংরক্ষিত করা হয়েছে। অর্কিড দ্বীপটি পর্যটনের জন্য খুলে দেয়ার পর থেকে এই পরিবর্তন সংঘটিত হয়।[৫]

তাইওয়ানের জাতীয় সরকারের আমলে সেনাবাহিনী অর্কিড দ্বীপে পর্যটকের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৯৬৭ সালে কেই-ইউয়ান (Kaiyuan) বন্দর সরকারীভাবে খুলে দেয়া হয় এবং এর ফলে পর্যটন শুরু হয়। ১৯৭০ সালে অর্কিড দ্বীপে আকাশ পথ খুলে দেয়া হলে পর্যটন বৃদ্ধির সূচনা ঘটে। উল্লেখ্য, তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইংওয়েন সম্প্রতি সে দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার উপর অতীতের নিপীড়ন নির্যাতনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং তাদের জমি ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাইওয়ানে সরকারীভাবে স্বীকৃত ১৪টি জাতিসত্তা রয়েছে।[৬] 

ল্যাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা
বিশ্ব ব্যাংক ল্যাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোর আদিবাসী জনগণের সাথে তাদের কাজের অভিজ্ঞতার সার সংকলন করে লিখেছে “পর্যটন আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য সুফল আনতে পারে, তবে আদিবাসীদের জন্য তার খারাপ দিকও রয়েছে।” ল্যাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সিনিয়র ইকনমিস্ট হিসেবে কর্মরত দর্তি ভার্নার (Dorte Verner) ‘আদিবাসীদের’ জন্য পর্যটনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, “কলম্বিয়ায় আদিবাসীদের সাথে কাজের কর্মসূচীর অংশ হিসেবে পর্যটন প্রতিমন্ত্রী সিয়েরা নেভাদা অঞ্চলের কোগি জনগণের কাছ থেকে এথনো-ট্যুরিজম বিষয়ে তাদের মতামত নেন। কলম্বিয়ার অধিকাংশ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং প্রাক-কলম্বিয়া যুগের প্রত্নতাত্তিক সম্পদ কোগি’দের অঞ্চলে রয়েছে। কোগিরা সরাসরি জানিয়ে দেন তারা পর্যটন গন্তব্য হতে চান না। পর্যটন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাদের মতামতকে সম্মান জানান এবং পর্যটন থেকে কোগিদের রক্ষা করতে নীতিমালা বাস্তবায়ন করছেন।”[৭]

দর্তি প্রশ্ন করেন কেন কোগিরা এমন মত দিলো? তার নিজের এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দেন এবং আন্ড্রেস ব্যারোনার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “প্রথমত পর্যটন থেকে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক লাভের অংকটা যেমনটা বড় হবে বলে আশা হয় আদতে তা হয় না। কলম্বিয়ার আমাজনে ইয়েওয়ে দর্শনার্থী কেন্দ্রে (Yewae Visitor Centre) আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো সম-অংশীদার হিসেবে কেন্দ্র থেকে নেট আয়ের ১০% পেলেও এবং তাদের ২০ জন সদস্য সার্বক্ষণিক চাকুরীতে নিযুক্ত হলেও, তাদেরকে সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগতভাবে চড়া মূল্য দিতে হয়। গত চার বছরে ইয়েওয়ে দর্শনার্থী কেন্দ্রে দর্শনার্থীর সংখ্যা চারগুণ বেড়েছে, যার ফলে পর্যটকদের জন্য হস্তশিল্প ও খাদ্য দ্রব্য তৈরি করতে গিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিক মাত্রায় চাপ পড়ে। দর্শনাথীরাও আদিবাসী সম্প্রদায়কে ভোগবাদের নতুন নতুন স্তরের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়। আর ভালো মন্দ যাই হোক, অর্থনৈতিক লাভের ফলে নতুন প্রয়োজনও দেখা দেয়: যেমন ফ্লাশ লাইট, স্কুলের সরঞ্জাম এবং ‘জিনিসপত্র’। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই তরুণ প্রজন্ম নিজেদের তিকুনা ভাষার প্রতি অনাগ্রহ দেখাচ্ছে এবং আচার-আচরণেও তিকুনা হবার আগ্রহ হারাচ্ছে। ব্যারোনা এমনকি সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল পর্যটন কেন্দ্র থেকেও কলম্বিয়ার আমাজনে জীব বৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।”[৮]

টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফলিত জীব বৈচিত্র্যের অধ্যাপক আমান্ডা স্ট্রোনজা পেরুতে একটি আদিবাসী সম্প্রদায় এবং তাদের নিজেদের পরিচালিত পর্যটন কর্মসূচীর উপর একটি দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণা চালান। এই পর্যটন কর্মসূচী সার্বিকভাবে আয় বৃদ্ধি করেছে, তবে সবার জন্য অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটায়নি। এখন শহরে নতুন ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইডদের মধ্যে আয় কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যারা এখন আর ঐতিহ্যগত উৎপাদনের কাজে অংশগ্রহণ করেন না। ট্যুর অপারেটররা গরু ছাগল পালনের জন্য রক্ষিত বনাঞ্চলে জমি কিনেছে। এভাবে পর্যটন জাতিসত্তার ঐতিহ্যগত কাঠামোতে এবং জীব বৈচিত্র্যে আঘাত হেনেছে।[৯]

রাঙামাটির সাজেকের রুইলুই পর্যটন কেন্দ্র। এই পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কারণে নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের শিকার হতে হচ্ছে পাহাড়িদের।

সংখ্যালঘু জাতির উপর পর্যটনের নেতিবাচক প্রভাব
পর্যটনকে টেকসই উন্নয়নের দাওয়াই হিসেবে প্রচার করা হয়। কিন্তু পর্যটনের কথিত সুফল যেমন চাকুরী সৃষ্টি, অবকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদি আদিবাসীদের ঘরে পৌঁছায়নি। পর্যটন শিল্পের ধ্বংসাত্মক প্রবণতা যেমন পরিবেশ দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিশাল সমস্যা, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, শ্রম ও মজুরী বৈষম্য, সংস্কৃতির পণ্যকরণ ইত্যাদি বিশ্বের বহু আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে।[১০]

নিচে সংখ্যালঘু জাতি বা আদিবাসীর উপর পর্যটনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:

১.ভূমি থেকে উচ্ছেদ: পর্যটনের কারণে নিজ জমি-বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়া, জমির উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর অভিজ্ঞতা পৃথিবীর অধিকাংশ আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জাতির রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণও তার ব্যতিক্রম নয়। বান্দরবানে ম্রো জাতির লোকজনকে উৎখাত করে পর্যটনের হোটেল, মোটেল বানানো হয়েছে। এতে তারা নিজেদের জুম চাষের জমির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। বর্তমানে খাগড়াছড়ির আলুটিলায় ৭০০ একর জমিতে বিশেষ পর্যটন জোন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কয়েক হাজার ত্রিপুরা জাতিসত্তার লোকজন তাদের বংশপরম্পরার জমি থেকে চিরতরে উৎখাত হবেন।

২.মানবাধিকার লঙ্ঘন: জোর জবরদস্তিমূলক পর্যটনের সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘন গলায় জড়াজড়ি করে চলে। বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়ে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭ ) হেডম্যান রাংলাই ম্রো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছিলেন।

৩.বন ও পরিবেশ ধ্বংস: অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন বন ও পরিবেশের চরম ক্ষতি করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫-২০০৬ সালে রাঙামাটির সাজেকে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে বাঘাইহাট থেকে রুইলুই মোন বা পাহাড় পর্যন্ত প্রশস্ত পাকা রাস্তা তৈরী করা হয়। এর ফলে এক সময় গভীর বনে আচ্ছাদিত সাজেক অঞ্চল এখন বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। পরিবহনের সুবিধার কারণে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটা হয়েছে। শতবর্ষী বিরল প্রজাতির গাছ যেমন চাপালী, গর্জন ইত্যাদি ধ্বংস করা হয়েছে।

৪.পণ্যকরণ: সংখ্যালঘু জাতিসত্তার এলাকায় পর্যটন তাদের সাংস্কৃতিকে পণ্যে রূপান্তরিত করে। পর্যটন হলো মূলত একটি ব্যবসা, এবং যে কোন ব্যবসার মতো এর প্রধান বা একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা। অন্যান্য পণ্য যেমন ক্রেতার চাহিদা লক্ষ্য করে প্রস্তুত করা হয়, আকর্ষণীয় করতে রঙচড়িয়ে উপস্থাপন করা হয়, সংখ্যালঘু জাতির সংস্কৃতিকেও তেমনিভাবে পর্যটকদের কাছে উপস্থাপনের চেষ্টা চলে। এভাবে তাদের সংস্কৃতিকে বিকৃত করা হয়।

৫.হীনমন্যতার সৃষ্টি: অনেক পর্যটক ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা থেকে আসে আমোদ ফূর্তির খোঁজে। তাদের জীবনধারা অন্য রকম। তারা কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে এবং সবকিছু টাকা দিয়ে পেতে চায়। তারা উন্নত আধুনিক প্রযুক্তি, মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি ব্যবহার করে। স্থানীয় সমাজে এর প্রভাব পড়ে এবং অনেকে তাদের আচরণ হুবহু অনুকরণ করতে চায়। এতে নানারকম পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়।

৬.অপরাধ বৃদ্ধি: গণ পর্যটন বৃদ্ধির সাথে সাধারণত অপরাধও বেড়ে যায়। যেমনটা ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে দেখা গেছে।

৭.জীবিকার উপায় ধ্বংস: পর্যটন স্থানীয়দের ঐতিহ্যগত জীবিকার উপায় বা আত্ম-নির্ভরশীল অর্থনীতিকে ধ্বংস বা হুমকির সম্মুখীন করে।

৮.নিজ এলাকায় প্রবেশাধিকার নিষেধ: পর্যটনের উন্নয়নের ফলে নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা অসংখ্য। ফিলিপাইনে বোড়াকে দ্বীপের (Boracay Island) এক চতুর্থাংশ কিনে নেয় বাইরের একটি কর্পোরেশন। এতে স্থানীয়দের মধ্যে পানির সংকট দেখা দেয়। একইভাবে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে বড় বড় হোটেল ও গল্ফ খেলার মাঠের জন্য উন্নত কৃষি জমি ও পানি সরবরাহ নিয়ে যাওয়া হয়।[১১]

৯.বেশ্যা বৃত্তি: পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পর্যটন বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশু ও মেয়েদের যৌন ব্যবসায় ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। পর্যটন একই সাথে ভোগবাদও নিয়ে আসে। ফলে একটি টিশার্ট, কিছু নগদ টাকা, বাইক, প্লেনের টিকেট ইত্যাদির বিনিময়ে দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত হতে শিশু ও মেয়েরা সহজেই প্রলুব্ধ হয়।

ট্রাইবাল ট্যুারিজম বা উপজাতি পর্যটন
আজকাল ট্রাইবাল ট্যুরিজম নামে এক ধরনের পর্যটন প্রচলিত হয়েছে। এটা এমন এক ধরনের পর্যটন যেখানে ‘উপজাতিরা’ পর্যটকদেরকে তাদের গ্রামে ভ্রমণের সুযোগ দেয়, যাতে এই পর্যটকরা তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ‘উপজাতি’ সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এ ধরনের পর্যটন বিশেষত গড়ে উঠেছে ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে, যেমন পেরু, ব্রাজিল ও গুয়েতেমালায়। এই ধরনের পর্যটনে আর্থিক লাভ এবং ‘আদিবাসীদের’ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও, এর সামাজিক ক্ষতির দিক প্রচুর। যেসব অঞ্চলে ‘ট্রাইবাল ট্যুরিজমের’ বিস্তার ঘটেছে সেখানে ‘আদিবাসীদের’ সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটেছে। ‘আদিবাসীরা’ যে জিনিসকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে, পুজো করে, অনেক পর্যটক সেগুলোকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকে। ফলে ‘আদিবাসীদের’ সম্পর্কে তাদের মনে খারাপ ধারণা গড়ে উঠে। এ কারণে গার্জিয়ান পত্রিকার মতে, বিশে^ প্রায় ১০০টি ‘আদিবাসী উপজাতি’ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।[১২]

ইকো ট্যুরিজম
বর্তমান বিশ্বে ইকো ট্যুরিজম বেশ জনপ্রিয় হলেও তা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সংখ্যালঘু জাতির ওপর কিরূপ বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে তা ইতিমধ্যে কিছুটা বলা হয়েছে। ইকো ট্যুরিজমের নামে প্রায়শ মূল্যবান উদ্ভিদ ও প্রাণীর অনুসন্ধান ও বাইও-পাইরেসি বা জীববৈচিত্র্য চুরির ঘটনা ঘটে থাকে। অনেক ইকো ট্যুরিজম সম্পর্কিত ভ্রমণের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ধরনের ভ্রমণের সময় বিজ্ঞানী, পর্যটক, ছাত্র ও গবেষকরা বনে প্রবেশ করে স্থানীয় গাছপালা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ-ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও জীববৈচিত্র্য চুরি করে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে বহু শতাব্দী ধরে সঞ্চিত জ্ঞান-ভাণ্ডার চুরি ও প্যাটেন্ট করার চেষ্টা চালায়।[১৩]

ইকো ট্যুরিজমের নামে ‘আদিবাসীদের’ শত শত বছরের অভিজ্ঞাতা সমৃদ্ধ জ্ঞান ভাণ্ডার চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অমূলক নয়। এসব কারণে ইকো ট্যুরিজম কোন কোন অঞ্চলে ‘আদিবাসীদের’ সমর্থন লাভ করেনি। যেমন উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৭ সালে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ‘আদিবাসীরা’ তাজ রিসোর্ট হোটেলের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাজ হলো আন্তর্জাতিক এনভায়রনমেন্ট ইনিশিয়েটিভ-এর সদস্য এবং টেকসই ট্যুরিজম সৃষ্টির জন্য এই তাজ হোটেলকে প্রশংসা করা হয়। ‘আদিবাসীরা’ তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর বনে প্রবেশাধিকার হারানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং নাগারাহোল ন্যাশন্যাল পার্কে তাজের একটি ইকো রিসোর্ট তৈরির বিরোধীতা করে। বন রক্ষা করতে গিয়ে ২০ জন ‘আদিবাসী’ গ্রেফতার হন। আদালতে আইনী লড়াইয়ে ‘আদিবাসীরা’ জয়লাভ করেন। তাজ হোটেলের দাবি তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় লোকজন লাভবান হতেন, কিন্তু ‘আদিবাসীরা’ বলেন ‘উন্নয়নের’ সম্ভাব্য লাভালাভের বিষয়টি তাদের কাছে মুখ্য নয়, তাদের কাছে মুখ্য বিষয় হলো তাদের জমি, সম্পদ ও সংস্কৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ।[১৪]

পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন
পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পর্যটনকে দাওয়াই হিসেবে প্রচার করা হয়। এ অঞ্চলের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, পাহাড়-পর্বত, নদী-ঝর্ণা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম হ্রদ, স্থানীয় উৎসব-সংস্কৃতি ইত্যাদি দেশী বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ করতে সমর্থ। ভেলাম ভেন সেন্দেল পার্বত্য চট্টগ্রামকে A rustic paradise  (অকৃত্রিম স্বর্গ) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ‘দ্যা চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস, লিভিং ইন এ বর্ডারল্যান্ড’ বইয়ে তিনি ও অন্যরা লেখেন, যে সকল পশ্চিমা ব্যক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছেন তাদের প্রায় সকলে স্থানীয় জনগণের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন। অধিকাংশ পর্যটক এ অঞ্চল সফর শেষে এক রোমান্টিক স্মৃতি নিয়ে ফিরে যান। এক পর্যটকের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই বইয়ে তারা লেখেন, যারাই পাহাড়ে (পার্বত্য চট্টগ্রামে) প্রবেশ করে তারা সবাই পরিবর্তিত মানুষ হিসেবে বের হয়ে আসে।[১৫]

বগালেক, বান্দরবান। ছবি সংগৃহীত

বৃটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল এক্সক্লুডেড এরিয়া। তখন এখানে রাস্তাঘাট ও যানবাহনের উন্নয়ন ঘটেনি। এ কারণে সে সময় পর্যটকদের আগমণ ছিল সীমিত। মূলতঃ খৃষ্টান ধর্ম প্রচারক, ইউরোপিয়ান প্লান্টার ও ব্যবসায়ীরা সেখানে যাতায়ত করতেন। যতদূর জানা যায়, বিদেশীদের মধ্যে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেন ফ্রান্সিস বুকানন ১৭৯৮ সালে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলার চট্টগ্রামের সাথে জুড়ে দেয়ার ৬২ বছর আগে। তিনি মূলতঃ মসলা চাষের উপযুক্ত জায়গা খোঁজার জন্য দক্ষিণ পূর্ব বাংলাদেশ সফরের সময় কার্পাস মহলেও (তখনকার পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম) গিয়েছিলেন।[১৬]

পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারীভাবে পদক্ষেপ নেয়া হয়। ১৯৬০ দশকে পর্যটক আকর্ষণের জন্য প্রচারিত একটি লিফলেটে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, নয়নাভিরাম কাপ্তাই হ্রদ, পাহাড়িদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা তুলে ধরা হয়; তাদের সংস্কৃতি ও নারীদের সৌষ্ঠব পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ভেলাম ভেন সেন্দেল ও অন্য দুই লেখকের যৌথভাবে লেখা উপরোল্লেখিত বইয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পর্যটন বিভাগের দেয়া কাপ্তাই হ্রদের ছবি সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই বিজ্ঞাপনে কাপ্তাই লেকে স্পিডবোটিং করে ছুটি কাটানোর জন্য পর্যটকদের আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।[১৭] কিন্তু তারপরও পাকিস্তান আমলে পর্যটন কর্মসূচী সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। একই বইয়ে তারা লিখেছেন, ‘কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি গুরুত্বর্পূ পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করতে লোকাচার ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যথেষ্ট নয়। পর্যটন কর্তৃপক্ষ সাংগ্রিলার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকারের অন্যান্য বিভাগগুলো পর্যটকদের এবং বিশেষত বিদেশী পর্যটকদের প্রতি আন্তরিক ছিল না। যারা রাঙামাটি ও কাপ্তইয়ের বাইরে পাহাড়ের আরো কিছু দেখতে চাইতো তাদেরকে বলা হতো ‘সরকারের কাছ থেকে পূর্বানুমতি লাগবে’। বাস্তবে বৃটিশ আমল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাইরের লোকজনের জন্য  বলতে গেলে নিষিদ্ধ রয়েছে। ফলে পর্যটন এখানে খোঁড়া অবস্থায় রয়ে গেছে। এর বিকাশের চেষ্টা ব্যর্থ হয়।’[১৮]

# পাকিস্তান আমলে ট্যুরিস্ট আকর্ষণের জন্য বিজ্ঞাপন, সৌজন্যে দ্যা চিটাগাঙ হিল ট্র্যাক্টস, লিভিং ইন এ বর্ডারল্যান্ড, ভেলাম ভেন সেন্দেল ও অন্যরা, ২০০১।

বাংলাদেশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র যুদ্ধ চলার সময় পর্যটন শিল্পের বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তবে এ সময় পাহাড়ে সামরিক ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে রাস্তাঘাটের যথেষ্ট উন্নতি সাধন করা হয়। সমতল জেলার সাথে ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক যোগাযোগ বেড়ে যায়। পার্বত্য চুক্তির পর সরকার পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসারের জন্য সচেষ্ট হয়। তিন জেলায় হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়। পর্যটন জোন, কেন্দ্র ও স্পট গড়ে তোলা হয়। এগুলোর মধ্যে বান্দরবানে মেঘলা, নীলগিরি, বগালেক, রাঙামাটিতে ঝুলন্ত ব্রিজ, শুভলঙের জলপ্রপাত, খাগড়াছড়িতে আলুটিলার গিরিসুরঙ্গ, রিঝাং ঝর্ণা, দেবতাপুকুর ইত্যাদি। এমনকি বৌদ্ধ স্থাপত্য ও মন্দিরগুলোও পর্যটকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়। এগুলোর মধ্যে রাঙামাটির রাজবন বিহার, বান্দরবানের রাম জাদি মন্দির, স্বর্ণ মন্দির, খাগড়াছড়ির ইয়ংড বৌদ্ধ বিহার ও শান্তিপুর অরণ্য কুটির উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু সরকার যেভাবে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে তাতে কেবল একটি অতি ক্ষুদ্র বিত্তশালী গোষ্ঠী বা monied class -কেই লাভবান করছে। আর দুর্ভাগ্যবশতঃ এই শ্রেণীর যারা অন্তর্ভুক্ত তারা প্রায় সবাই বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর লোক। অপরদিকে জোরজবরদস্তিমূলক উপনিবেশিক কায়দায় পরিচালিত পর্যটন পাহাড়ি জাতিগুলোর জন্য সুফল বয়ে আনার পরিবর্তে তাদের সর্বনাশই ডেকে আনছে। পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার নামে তাদেরকে ঐতিহ্যগত জুম চাষের জমি ও ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করা হয়েছে ও হচ্ছে। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে নীলগিরি নামে একটি পর্যটন রিসোর্ট নির্মাণের জন্য মুরুংদের জমি দখল ও তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে রাংলাই মুরুংকে গ্রেফতার ও অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। সাজেকে পর্যটনের জন্য রাস্তা নির্মাণের কারণে রিজার্ভ ফরেস্ট উজার হয়েছে এবং রুইল্ইু পাহাড়ে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের ফলে সেখানে বসবাসরত পাহাড়ি বিশেষত পাংকো জাতিসত্তার জনগণ এখন উচ্ছেদের সম্মুখীন। বর্তমানে খাগড়াছড়ির আলুটিলায় ৭০০ একর জমিতে বিশেষ পর্যটন জোন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এর ফলে কয়েক হাজার ত্রিপুরা জাতিসত্তার লোকজনের মধ্যে ওই এলাকা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

রিছাং ঝর্ণা, আলুটিলা, খাগড়াছড়ি। সম্প্রতি এই এলাকায় পাহাড়িদের ৭০০ একর জায়গায় পর্যটন জোন গঠনের সরকারীভাবে প্রক্রিয়া চলছে।

আর্থিকভাবেও পাহাড়িরা পর্যটন থেকে লাভবান হতে পারছেন না। পর্যটনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসা যেমন হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যাটারিং, যানবাহন ইত্যাদি সবই বাঙালিদের একচেটিয়া দখলে। এক কথায় পর্যটন বাঙালিদের মধ্যে একটি শ্রেণীকে লাভবান করলেও পাহাড়িদের জন্য তা চরম অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারা ইতিমধ্যে প্রান্তিক অবস্থান থেকে আরো অধিকতর প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছে।

পাহাড়িরা পর্যটনের সুফল না পাবার কারণ হলো মূলতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা না থাকা এবং পর্যটন যেভাবে সংগঠিত করা হচ্ছে তাতে তাদের কোন মতামত ও নিয়ন্ত্রণ না থাকা। বর্তমান আইন মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় পর্যটন জেলা পরিষদের এক্তিয়ারভুক্ত। কিন্তু এই আইন কেবলমাত্র কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। পর্যটনের জন্য জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে পরিকল্পনা প্রণয়ন, পর্যটন জোন গঠন ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার এই ধাল-তলোয়ার-বিহীন জেলা পরিষদ নামক সর্দারকে পাশ কাটিয়ে সবকিছু করে থাকে। আর এভাবে জেলা পরিষদের নেতারা তাদের অজান্তে সবকিছু করা হলেও তারা এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করে না বা করতে পারে না। কারণ প্রথমত তারা সরকারের দাসানুদাস, সরকারের প্রতি ষাষ্ঠাঙ্গ আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে তাদের জেলা পরিষদের গদি লাভ হয়েছে। দ্বিতীয়ত এরা এমন গণ্ডমূর্খ যে তাদের হাতে কী ক্ষমতা আছে তাও তারা জানে না এবং সেই ক্ষমতা ব্যবহারও করতে পারে না। আসলে এই মূর্খতাই হলো তাদের দ্বিতীয় যোগ্যতা যার বলে তারা জেলা পরিষদে ঠাঁই পায়।

বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উন্নয়নের অর্থই হলো পুঁজি বিনিয়োগ। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুযায়ী পাহাড়ি জনগণের একটি অংশ তাদের উৎপাদনের বা জীবিকার উপায় (জমি) থেকে বঞ্চিত হয়ে সর্বহারা বা আধা-সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ভিড় জমাচ্ছে। জার্মান নৃতত্ত্ববিদ লরেঞ্জ লফলার পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন ও দারিদ্র্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এক কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল গাছ ও বাঁশ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল তাই নয়, ধান ও তুলারও বাড়তি উৎপাদন হতো। কঠোর পরিশ্রমী চাষীরা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল এবং সত্যিকার অর্থে গরীব লোকের সংখ্যা ছিল অল্প। বর্তমানে উন্নয়ন সাহায্যের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করার পর গরীব লোকের সংখ্যা বেড়েছে প্রচুর, ধান ও তুলা আমদানী করতে হচ্ছে এবং গাছ ও বাঁশ এত দুষ্প্রাপ্য হয়েছে যে, আদিবাসীদের আগেকার সুন্দর ঘরের স্থান দখল করেছে জরাজীর্ণ পর্ণকুটির।’[১৯] উন্নয়নের নামে এখন যে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো হচ্ছে তার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা যে আরো বেশী সঙ্গীন হয়ে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ নেই ।

এটা সত্য যে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিপুল বিকাশ ঘটেছে এবং তাদের মধ্যে দেশ-বিদেশ ভ্রমণের আর্থিক সক্ষমতাও তৈরি হয়েছে। আর দেশের ভেতরে পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো তাদের ভ্রমণের জন্য একটি আদর্শ স্থান। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ বাঙালি nouveau riche-দের এই ভ্রমণ পিপাসাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে নিজেরাও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে পারতেন। কিন্তু ইতিপূর্বে যেমনটা বলা হয়েছে, যেভাবে বা যে কাঠামোর মধ্যে পর্যটন সংগঠন করা হচ্ছে তা পাহাড়িদের উপর একপাক্ষিকভাবে চাপিয়ে দেয়া এবং এতে তারা লাভবান হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ অবস্থায় পাহাড়িদের ভবিষ্যত কী? উপনিবেশিক শাসকরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই উপনিবেশগুলোতে ‘উন্নয়ন’ করে থাকে। তবে অনেক সময় তার ফলাফল হয় সুদূরপ্রসারী। যেমন বৃটিশরা ভারতে সামরিক প্রয়োজনে এবং কল কারখানায় সস্তায় তুলা ও অন্যান্য কাঁচামাল পরিবহণের জন্য রেল ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল। কিন্তু তা ভারতের বিভিন্ন অংশ ও জনগণের মধ্যে ঐক্য ও যোগাযোগের সুযোগও করে দেয়। কার্ল মার্কস ১৮৫৩ সালে The Future Results of British Rule in India নামক প্রবন্ধে ভারতে বৃটিশ প্রবর্তিত রেল ব্যবস্থার ভবিষ্যত ফলাফল কী হতে পারে তার আলোচনা শেষে বলেন, ‘ভারতীয়রা তাদের মধ্যে বৃটিশ বুর্জোয়াদের বিক্ষিপ্তভাবে ছিটানো নতুন সামাজিক উপাদানের ফল ঘরে তুলতে পারবে না, যতক্ষণ না খোদ গ্রেট ব্রিটেনে শিল্প সর্বহারারা বর্তমান শাসক শ্রেণীর স্থলাভিষিক্ত হয়, অথবা যতক্ষণ না হিন্দুরা নিজেরাই ইংরেজদের জোয়াল সম্পূর্ণ ছুঁড়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়।’[২০]

পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃটিশ আমলে যে উপনিবেশিক শাসন শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ আমলেও তার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। মার্কস তৎকালীন পরাধীন ভারতের ভবিষ্যত সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন তার আলোকে বলা যায়, বাংলাদেশে শাসক শ্রেণীর মধ্যে পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজে বর্তমান বাঙালি শাসকগোষ্ঠীর প্রবর্তিত ‘নতুন উপাদানগুলোর’ (বর্তমান ভাষায় উন্নয়নের) সুফল পাহাড়িরা ঘরে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না। তাহলে কি এই সুফল লাভের আগ পর্যন্ত তাদেরকে ‘রক্তপাত, কর্দমা, দুর্দশা ও লাঞ্ছনার’ মধ্য দিয়ে যেতে হবে?[২১]

——————-
[১] ‘Modern tourism, increasingly available to all classes of people in “developed countries”, began in large part with the development of the automobile and expanded road and highway systems. By the middle of this century (20th century) the development of commercial jet airlines enabled fast international travel and the tourism industry exploded. By the 1970s improvement of jet aircraft opend up the world to the tourism boom.’  The History of Indigenous Peoples and Tourism, https://www.culturalsurvival.org/ourpublications/csq/article/the-history-indigenous-peoples-and-tourism

[২] Globalization, Tourism and Indigenous peoples: What you should know about the world’s largest industry, by Lee Pera and Deborah Mclaren, 1999.

[৩] ‘The History of Indigenous Peoples and Tourism, https://www.culturalsurvival.org/ourpublications/csq/article/the-history-indigenous-peoples-and-tourism

[৪] ’  The History of Indigenous Peoples and Tourism, https://www.culturalsurvival.org/ourpublications/csq/article/the-history-indigenous-peoples-and-tourism

[৫] “With a respect to the ecology of Orchid Island and the culture of the Tao tribe, the impacts of tourism on the three protected wild animal species of Taiwan, including Elegant Scops owls, Birdwing butterflies, and coconut crabs, are relatively apparrent. These three animals play important roles in the culture of the Tao tribe and are indicators of the traditional biological resources. The strong cultural taboo strictly prohibits members of the Tao tribe from hunting and collecting these; however, these three species have become protected because their population numbers continue to decrease. Thier change occured after Orchid Island was opened for tourism” The culture and ecological impacts of aboriginal tourism: a case study on Taiwan’s Tao tribe, http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4117854/

[৬] New Age, August 2, 2016

[৭] Tourism and indigenous peoples: Lessons from recent expericences in eco and ethno tourism in Latin America and Caribbean, by Dorte Verner.

[৮] Tourism and indigenous peoples: Lessons from recent expericences in eco and ethno tourism in Latin America and Caribbean, by Dorte Verner.

[৯] Tourism and indigenous peoples: Lessons from recent expericences in eco and ethno tourism in Latin America and Caribbean, by Dorte Verner. en breve, Responsible Tourism Series, August 2009, Number 144.

[১০] Globalization, Tourism and Indigenous peoples: What you should know about the world’s largest industry, by Lee Pera and Deborah Mclaren, 1999.

[১১] Negative socio-cultural impacts from tourism: change or loss of indigenous identity and values, http://www.unep.org/resourceefficiency/Business/SectoralActivities/Tourism/FactsandFiguresaboutTourism/ImpactsofTourism/Socio-CulturalImpacts/NegativeSocio-CulturalImpactsFromTourism/tabid/78781/Default.aspx

[১২] Deteriorating cultures: The destructive effects of tribal tourism, by Grace Kranstover, Research Associate at the Council on Hemispheric Affairs, http://www.coha.org/deteriorating-cultures-the-destructive-effects-of-tribal-tourism

[১৩] ‘There are concerns about numerous “ecotourism” trips where scientists, tourists, students and researchers enter into forests to collect information about local plants and ecosystems, stealing biodiversity and, in some cases, attempting to patent life and the stealing of knowledge developed over centuries.’ Globalization, Tourism and Indigenous Peoples: What you should know about the World’s largest Industry, by Lee Pera and Deborah Mclaren

[১৪] The History of Indigenous Peoples and Tourism, https://www.culturalsurvival.org/ourpublications/csq/article/the-history-indigenous-peoples-and-tourism

[১৫] The Chittagong Hill Tracts, Living in a Borderland, by Willem van Schendel, Wolfgang Mey and Aditya Kumar Dewan, The University Press Limited, Dhaka, 2001

[১৬] Francis Buchanan in Southeast Bengal (1798) edited by Willem van Schendel, University Press Limited, Dhaka, 1992.

[১৭] The Chittagong Hill Tracts, Living in a Borderland, by Willem van Schendel, Wolfgang Mey and Aditya Kumar Dewan, The University Press Limited, Dhaka, 2001, page 211.

[১৮] “But folklore and natural beauty were not enough to make the Chittagong Hills an important tourist destination. While the tourism authorities promised a Sangri-La, other government departments were far less welcoming to tourists, especially foreign ones. Those wishing to see more of the hills than Rangamati and Kaptai were warned that “prior permission from government is required”. In reality, the Chittagong Hills have been largely off-limits for outsiders since British times. As a result, tourism remained stunned. Its development was a failure.’ The Chittagong Hill Tracts, Living in a Borderland, by Willem van Schendel, Wolfgang Mey and Aditya Kumar Dewan, The University Press Limited, Dhaka, 2001, page 211.

[১৯] ‘Once upon a time, the Chittagong Hill Tracts were not only rich in timber and bamboo, but they also produced a surplus of paddy and cotton. Hard-working farmers were … comparatively well off, and really needy people were few in number. Nowadays, after millions of dollars of development aid have been spent needy people abound, rice and cotton have to be imported, and timber and bamboo have become so scarce that the formerly magnificent houses of the indigenous people gave way to poot huts.’ Cited in Migration, land alienation and ethnic conflict: causes of poverty in the Chittagong Hill Tracts of Bangladesh, by Shapan Adnan, Research and Advisory Services, first edition 2004.

[২০] ‘The Indians will not reap the fruits of the new elements of society scattered among them by the British bourgeioise, till in Great Britain itself the now ruling classes shall have been supplanted by the industrial proletariat, or till the Hindoos themselves shall have grown strong enough to throw off the English yoke altogether.’ Karl Marx and Frederick Engels Selected Works, Volume one, Progress Publishers Moscow, Third Printing 1976, page 498.

[২১] একই প্রবন্ধে মার্কস লেখেন Has it (bourgeoise) ever effected a progress without dragging individuals and peoples through blood and dirt, through misery and degradation?

 


সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More