আজ মূল বিঝু

0

নিজস্ব প্রতিনিধি।। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি (বৈসু, সাংগ্রাই, বিঝু…) উৎসব চলছে । আজ ১৩ এপ্রিল চাকমা সম্প্রদায় পালন করছে ‘মূল বিঝু’। এই মূল বিঝুকে ত্রিপুরারা বলে বৈসুমা বা বৈসুকমা। আর মারমারা উৎসবের মূল দিনকে বলে আক্যেই। তবে মারমারা ১৪ এপ্রিলই উৎসবের মূল দিন হিসেবে পালন করে থাকে। নদী, ছড়ায় ফুল দেয়ার মাধ্যমেই গতকাল ১২ এপ্রিল পালিত হয়েছে উৎসবের ১ম দিন ফুল বিঝু।

Pajonমূল বিঝুর প্রধান আকর্ষণ ‘পাজন’। কমপক্ষে ২২ পদ বিভিন্ন শাক-সবজিসহ নানাবিধ শুটকির মিশ্রণে এ পাজন রান্না করা হয়। এই পাজন-ই হচ্ছে মূল বিঝুর মূল আকর্ষণ। এছাড়া এদিন বিভিন্ন পিঠা-পায়েসও তেরি করা হয়। চাকমাদের মধ্যে বিনি পিধা, সান্যাপিধা, কলাপিধা, বরাপিধা ইত্যাদি নাম উল্লেখযোগ্য। অতিথিরা ঘরে ঘরে ঘুরে পাজন খেয়ে বেড়ায়। মনে করা হয় কমপক্ষে ৭টি বাড়িতে পাজন খেলে অনেক রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়। তাই ঘরে ঘরে চলছে পাজনসহ অন্যান্য খাবার পরিবেশনের প্রস্তুতি। রান্নাবান্না শেষে সারাদিন চলে অতিথি আপ্যায়ন। অতিথিদের জন্য আজ সারাদিন উন্মুক্ত থাকবে গৃহদ্বার।

আগেকার দিনে শিশুরা এ দিনটির আশায় নানা ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে। তারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুরগীর খাদ্য (আধার) দিয়ে আসে। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম জানায় এবং তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। গৃহিনীরা তাদের নানান ধরনের পিঠা ও খাবার খেতে দেয়।  এদিন ভোর থেকে তরুণীরা দল বেঁধে নদী থেকে জল তুলে গ্রামের বুড়ো-বুড়িদের স্নান করায় আর তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করে।  আজকাল অবশ্য এ দৃশ্য খুব কমই চোখে পড়ে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রধান সম্প্রদায়ের উৎসবের নামের মূল আদ্যক্ষরযোগে বৈসাবি শব্দটি এখন বহুল পরিচিত। এই শব্দটিই পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত সম্প্রদায়গুলোকে সংকীর্ণ জাতীয়তার গন্ডি থেকে বের করে ঐক্যের মেলবন্ধন রচনা করেছে।

এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য সম্প্রদায়গুলোও ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করে থাকে। এর মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যারা এই উৎসবকে  বিষু, চাক সম্প্রদায় সাংক্রান এবং অহমিয়ারা বিহু নামে উৎসবটি নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন করে।

বৈসাবি’র সার-সংক্ষেপ:
বৈসুঃ  ত্রিপুরারা বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে বৈসুমা বা বৈসুকমা, তার আগের দিনটিকে হারি বৈসু এবং নববর্ষ প্রথম দিনটিকে বিসিকাতাল বলে। হারি বৈসুর দিন তারা বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে ঘর সাজায়, গরু, মহিষ, ছাগলসহ গৃহপালিত পশুদের খুব ভোরে ঘর থেকে ছেড়ে দেয়। ছেলে-মেয়েরা নতুন কাপড় পড়ে এই ঘর থেকে ঐ ঘরে ঘুরে বেড়াই। ত্রিপুরারা তাদের বৈসুমা দিনে তাদের বাড়িতে অতিথিদের মদ, পিঠা, পাচন দিয়ে আপায়ন করে ঐ দিন ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা নুনছড়ি দেবতা পুকুর বা নদী থেকে জল এনে তাদের নানা-নানী, দাদা-দাদীসহ স্থানীয় গুরুজনের স্নান করে তাদের কাছে আর্শীবাদ গ্রহণ করে। বৈসু সময় ত্রিপুরারা গরাইয়া নাচে শিল্পিরা পাহাড়ি পল্লী  ঘুরে ঐতিহ্যবাহী নিত্য পরিবেশন করে।

সাংগ্রাই:মারমারা সাংগ্রাইয়ের ১ম দিনকে পেইংছুয়ে (১৩ এপ্রিল)-২য় দিনকে আক্যেই মুল সাংগ্রাই (১৪ এপ্রিল) ৩য় দিনকে (১৫ এপ্রিল) আতাদা ও ৪র্থ দিনকে আপ্যেইং (১৬ এপ্রিল) হিসেবে পালন করে পুরানো বছরকে মুছে ফেলে নতুন বছর গ্রহণের ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী পানীয় উৎসব বা জলকেলী উৎসবের মাধ্যমে তারা যুবক-যুবতীদের একে অপরকে বর্ষ বরণ ও বিদায় পবিত্র বৃষ্টিতে সিক্ত করে। এই ছাড়াও পাড়ার যুবক যুবতীরা নদী থেকে পানি তুলে প্রবীণদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। অনেক এলাকায় দল বেঁধে বুদ্ধ মূর্তি গুলোকে গোসল করানো হয়। সারাদিন প্রস্তুতি চলে পরবর্তী দিন বা উৎসবের মূল দিনের খানাপিনা আয়োজন। উৎসবের ২য় দিনে প্রত্যেকের বাড়ীতে নানা মূখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। এতে ৩০-৩৭ বা তার বেশী আনাসপাতি দিয়ে তৈরী পাচন, পানীয় পরিবেশন করা হয়। সাংগ্রাই প্রধান উৎসবে কেন্দ্রস্থল মন্দির বা ক্যায়াং ঘরে প্রথম দিনে ভালভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় মেতে উঠে। দায়ক-দায়িকারা টানা তিনদিন অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় দীক্ষায় অভিভূত হয়ে বুদ্ধ মূর্তির সামনে ফুল রেখে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রণাম করে। পাড়ার লোকজন ক্যায়াং ঘরে গুরু ভিক্ষু, শ্রমণ, সাধু-সাধুমাদের উদ্দেশ্যে ছোয়াইং প্রদান করে। চন্দনের পানি, দুধ ও ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ মূর্তিকে স্নান করানোর মধ্য দিয়ে সূচনা হয় সাংগ্রাইং এর নতুন বছর । ঐ দিন তরুণ-তরুণীরা জলবর্তী পাত্র দিয়ে দলে দলে এসে সাংগ্রাইতে মিলেমিশে জলকেলি বা পানি খেলাতে মেতে উঠে।

 বিঝু: চাকমারা ১ম দিনকে ফুল বিঝু, ২য় দিনকে মুল বিঝু ও ৩য় দিনকে গোজ্জেপোজ্জে বিঝু হিসেবে পালন করে থাকে। উৎসবের প্রথম দিনে ঘরবাড়ি ও আঙ্গিনা পরিস্কার করা ও ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। এই দিন পাহাড়ি ছড়া, ঝর্ণা বা নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে মা গঙ্গাকে পূজা করে গোসল করা হয়। এ ছাড়াও পাড়ার যুবক যুবতীরা নদী থেকে পানি তুলে প্রবীণদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। অনেক এলাকায় দল বেঁধে বুদ্ধ মূর্তি গুলোকে গোসল করানো হয়। এরপর সারাদিন প্রস্তুতি চলে পরবর্তী দিন বা উৎসবের মূল দিনের খানাপিনা আয়োজন। উৎসবের ২য় দিনে (মূল বিঝু) প্রত্যেকের বাড়িতে নানা মূখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। এতে কমপক্ষে ২২ পদ বা তার বেশী আনাসপাতি দিয়ে তৈরী পাচন বা পাজনসহ নানাপ্রকার উপাদেয় খাবার পরিবেশন করা হয়। নানা বয়সী লোকজন সারাদিন দল বেঁধে হৈ-হুল্লা (আনন্দ) আওয়াজ করে ঘুরে বেড়ায়।  ৩য় দিনে দল বেঁধে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয়। এই দিন অনেকে পাড়ার বয়স্ক মুরব্বীদের বাড়ীতে ডেকে ভাল কিছু খাবার দেন। আর অনেকের উৎসবের তিনদিন মন্দির, বাড়ীর আঙ্গীনা, নদীর ঘাট, সবুজ গাছের নীচে এবং গোয়াল ঘরে বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে মোমবাতি জ্বালান।

বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলো নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধারণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। কাজের ব্যস্ততার আড়ালে সুখ দুঃখ, গ্লানি এই দেশের মাটি উর্বর হোক, ফুলে ফলে ভরে উঠুক শস্য ক্ষেত, পরিমিত বৃষ্টি জল-হাওয়া বর্ষিত হোক, প্রবাহিত হোক এই দেশের মাটিতে বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠি ও প্রাণীকূল সমান অধিকারে বেঁচে থাকুক এই প্রার্থনার মধ্য দিয়েই বৈসাবি উৎসব পালন করা হয়।
———————

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More