মুক্তমত

আদালতের আদেশে জামিনে মুক্তি পাওয়া পাহাড়িদের জেল গেট থেকে গ্রেফতার কেন?

0

– তুঙ চাকমা, হাতাই ত্রিপুরা, রিপ্লু মারমা, জিনু তংচঙ্গ্যা


রাঙ্গামাটিতে আদালত থেকে জামিন আদেশের পর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ৩ জন পাহাড়িকে জেল গেট থেকে পূনরায় সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে বলে  ‘হিল ভয়েস’ নামের একটি নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। এর আগেও আরো অনেককে এভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল থেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক জেল গেট থেকে গ্রেফতারের বেআইনি কার্যক্রম শুরু করা হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া আদালতে উপর সেনা গোয়েন্দাদের নজরদারির পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জর্জকোর্ট থেকে জামিন না দেয়ার গোপন নিষেধাজ্ঞাও জারি রাখা হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। কোন পাহাড়ি বন্দী আদালতের আদেশে জেল থেকে জামিনে বের হওয়ার আগে জেল সুপারকে রাঙ্গামাটি সেনা রিজিয়নে খবর দিতে হয়, তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। সেনা রিজিয়নের অনুমতি ছাড়া পাহাড়ি বন্দীদের ছেড়ে দিতে পারে না জেল কর্তৃপক্ষ। সেনাবাহিনী থেকে নিষেধ করা হলে তারা (সেনা সদস্যরা) জেল গেটে না আসা পর্যন্ত জামিনপ্রাপ্ত বন্দীদের জেলের ভিতর অফিসে বসিয়ে রাখতে বাধ্য হয় জেল কর্তৃপক্ষ। যখনই সেনাবাহিনীর সদস্যরা জেলগেটে এসে পৌঁছবে তখনই জামিন পাওয়া কোন বন্দীকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হলে তখন জেল গেটে অপেক্ষায় থাকা সেনা সদস্যরা সাথে সাথেই ওই বন্দীকে পূনরায় গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের পর নতুন কোন মামলায় জড়িয়ে দেয়।

হিল ভয়েসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ আদালত থেকে জামিনে মুক্তির আদেশের পর আনুমানিক সন্ধ্যা ৬ টা নিকোলাই পাংখোয়া (৫৫) ও রূপায়ন চাকমাসহ অজ্ঞাতনামা আরও দুই পাহাড়ি রাঙ্গামাটি জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় সেখানে আগে থেকে অবস্থানরত কয়েকজন সেনাবাহিনীর সদস্য অস্ত্রের মুখে নিকোলাই পাংখোয়া ও আরও দুই ব্যক্তিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অপর এক ব্যাক্তি রুপায়ন চাকমা তিনি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।

এর আগে ২০১৯ সালেও অন্তত ১০ জনকে জেল গেট থেকে পুন:গ্রেফতার করে সাজানো মিথ্যা মামলা দেয়া হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।

এতেই প্রতীয়মান হয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষত রাঙ্গামাটি কারাগারে পাহাড়ি বন্দীদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিভাবে নিপীড়ন জারি রেখেছে।

বাংলাদেশ সংবিধান সকল নাগরিকদের আইনি সুবিধা পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে- ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। ৩১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে-‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’।

তাহলে প্রশ্ন হলো, কোন আইন দেখিয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক আদালত থেকে জামিন পাওয়া পাহাড়ি বন্দীদের জেল গেট থেকে পুন:গ্রেফতার করে নতুন মামলায় জড়ানো হচ্ছে? এটা কী নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে পদধুলিত করা নয়?

পাহাড়ি বন্দীরাতো এদেশের নাগরিক, আইনে তাদেরও সমান অধিকার পাওয়ার বিধান রয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারে কেমন করে? যদি কোন বন্দীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে কারাগারে থাকাকালীন পুলিশ তাকে গ্রেফতারে আদালতে আবেদন জানাতে পারে। কিন্তু সম্পুর্ণ বেআইনিভাবে সেনাবাহিনী জেল গেট থেকে গ্রেফতার করবে কেন? তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশ প্রশাসনের কাজ কি?

পাহাড়িরা কেন আইনী সুরক্ষা পাবে না? তাদের কী বছরের পর বছর বিনা বিচারে কারাগারে বন্দী জীবন-যাপন করতে হবে? তাদেরও তো রয়েছে পরিবার-পরিজন, কোমলমতি শিশু, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে। পরিবারের কর্তা হিসেবে ভরণ-পোষণের দায়-দায়িত্বও তো তাদের রয়েছে। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা জোরজবরদস্তি করে এভাবে বছরের পর বছর কারাগারে আটক করে রাখা হলে তাদের পরিবারের কী হবে?

মুলত সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ঔপনিবেশিক শাসন জিইয়ে রেখে পাহাড়ি জনগণের ওপর শাসন-শোষণ, দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে সেনাবাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে পাহাড়ি জনগণের অস্তিত্বকে ধ্বংস করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র, অপকৌশল প্রয়োগ করছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর ‘১১ দফা নিদের্শনা’ জারি করে পাহাড়ে সেনাশাসনকে বৈধতা দিয়েছে। এর ফলে সেনাবাহিনী দেশের আইনকেও অসম্মান করতে দ্বিধাবোধ করছে না।

সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে দিয়ে পাহাড়ি জনগণের উপর যেভাবে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এর থেকে আমরা সুরক্ষা পেতে চাই। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বসবাসরত নাগরিকদের মত আমরাও সুস্থ-সুন্দর ও শান্তিতে, নির্বিঘ্নে বসবাস করতে চাই। সরকারের জাতি ধ্বংসের চক্রান্তের অবসান চাই। আমরা জাতিগত বৈষম্য চাই না, পাহাড় ও সমতলে রাষ্ট্রের দুই নীতির শাসন ব্যবস্থা আমরা চাই না।

তাই আমরা দেশের প্রগতিশীল সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা, বুদ্ধিজীবী সমাজ, সচেতন নাগরিক সমাজসহ আপামর জনগণের কাছে সবিনয়ে আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িরাও এদেশের নাগরিক। আসুন দলমত নির্বিশেষে পাহাড়িদের পাশে দাঁড়ান, তাদের সহযোগিতা করুন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পাহাড়িদের সাথে এক হোন। পাহাড়িদের নিরাপত্তা, নাগরিক সুরক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সকলে এগিয়ে আসুন।

একই সাথে আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এহেন অন্যায় কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি এবং রাঙ্গামাটি জেল গেট থেকে গ্রেফতারকৃত তিন পাহাড়িকে মুক্তির দাবিসহ অবিলম্বে এ ধরনের অন্যায় গ্রেফতার বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি।

* লেখকগণ পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক।

 

[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More