আন্তর্জাতিক নারী দিবসে রাঙামাটির কুদুকছড়িতে বিশাল নারী সমাবেশ
সিএইচটি নিউজ ডটকম
রাঙামাটি : ‘কেবল প্রতিবাদ বিক্ষোভে নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে প্রস্তুত হও নারী সমাজ’ এই শ্লোগানে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে রাঙামাটি সদর উপজেলার কুদুকছড়ির বড় মহাপুরুম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক বিশাল নারী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি, দীঘিনালা, বাঘাইছড়ি, সাজেক, মা’লছড়ি, লক্ষীছড়ি, মাটিরাঙ্গা, মানিকছড়ি, রামগড়, গুইমারা, কাউখালী, নান্যাচর ও লংগুদু উপজেলা থেকে শত শত নারী বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া সম্বলিত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড বহন করে সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই শত শত নারীর অংশ গ্রহণে সমাবেশের জন্য নির্ধারিত প্যান্ডেল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।
‘আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়…’ এই আন্তর্জাতিক সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে সমাবেশের কার্যক্রম শুরু করা হয়। সংগীত পরিবেশনের সময় সবাই দাঁড়িয়ে তুমুল করতালি ও শ্লোগানের মাধ্যমে সমাবেশস্থল মুখরিত করে তোলে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরুপা চাকমার সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রিনা চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) বান্দরাবন জেলার প্রধান সংগঠক ছোটন কান্তি তংচঙ্গ্যা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সভাপতি সোনালী চাকমা, ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের অন্যতম সংগঠক মিঠুন চাকমা, নির্বাচিত জুম্ম প্রতিনিধি সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুপন চাকমা, নির্বাচিত জুম্ম প্রতিনিধি সংসদের সদস্য ও কুদুকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সন্টু বিকাশ চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা ও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিপুল চাকমা প্রমূখ। পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সাধারণ সম্পাদক কাজলী ত্রিপুরা সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, আজকে সারাদেশে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন পর্যায়ে নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নসহ সর্বোপরি নারী-পুরুষের সমানাধিকারের দাবীতে নারী দিবস পালিত হচ্ছে। আমরা এখানে সমবেত হয়েছি কোন আনন্দ-উৎসব করতে নয়, অঘোষিত সেনাশাসন ও সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখলের যে মহোৎসব চলছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ যদি তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে তাহলে আলাদাভাবে নারী অধিকারের জন্য আন্দোলন করে কোন লাভ নেই। এখানে আমাদের সংগঠনের অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটা অগণতান্ত্রিক ও সংবিধান পরিপন্থি। নারী সমাজের অধিকারের আন্দোলন কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, সারাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে দমন-পীড়ন জারি রয়েছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। বক্তারা জেএসএস প্রধান সন্তু লারমার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন, ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন জোরদার করতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ব্যতীত কোন আন্দোলই সফল হতে পারে না।’
সমাবেশে নারী নেত্রী সোনালী চাকমা বলেন, আজকের এই দিনটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘নারী দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। আমাদের এই সমাবেশ একটি ব্যতিক্রম ধর্ম্মী সমাবেশ। নারী অধিকারের পাশাপাশি জাতিগতভাবে যে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন চলছে তার বিরুদ্ধেও আমাদেরকে জীবনবাজি রেখে আান্দোলন-সংগ্রাম করতে হচ্ছে। গোটা বাংলাদেশের পরিস্থিতির চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদেরকে সুন্দরী সাজার চেয়ে অধিকারের প্রশ্নে আরো অধিকতর সচেতন হতে হবে। ঘিলাছড়ি এলাকার নারীরা যেভাবে অন্যায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করেছিল সেই আন্দোলন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। ঠিক একইভাবে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদের ভিটে-বাড়ি রক্ষা তথা ভূমি অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। নারী ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনা ও গণহত্যার একটিরও বিচার হয়নি। যেকারণে এই সমস্ত ঘটনার যারা মূল নায়ক তারা আরো উৎসাহিত হয়ে ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সমাজ, জাতি রক্ষার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও করতে হবে। এছাড়া, আমাদের সামনে অন্য কোন উপায় নেই। আমাদের সমাজে আগে ‘ধর্ষণ’ শব্দটির সাথে কেউ পরিচিত ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে এই অবস্থায় নারী সমাজের কারোর ঘরে বসে থাকার জো নেই। কারণ, ঘরে-বাইরে কোন নারীই আজ নিরাপদ নন।
তিনি আরো বলেন, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে নারী সমাজের নিরাপত্তা বিধানের জন্য পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের কোন বিকল্প নেই। জাতীয় সংসদে পাহাড়ি নারীদের জন্য ৩টি আসন সংরক্ষণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী ধর্ষণ ও হত্যার সাথে যারা জড়িত তাদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার পূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য তিনি জোর দাবী জানান। একই সাথে উপস্থিত সমাবেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নারী সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই-সংগ্রামে শরীক হতে হবে।
ইউপিডিএফ নেতা ছোটন কান্তি তংচঙ্গ্যা বলেন, বান্দরবান জেলায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠির সকল সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলার তুলনায় বান্দরবান জেলার জাতিসত্তাগুলো শিক্ষা-দীক্ষা ও রাজনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এক সূত্রে গাঁথা। একটি সমাজ ও জাতি পরিপূর্ণভাবে বিকাশের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, অধিকারের জন্য আমরা যদি সবাই ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে পারি তাহলে কোন শক্তিই আমাদেরকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
সমাবেশ শেষে নারী অধিকারের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন পূর্বক একটি বর্ণাঢ্য র্যালী কুদুকছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ করে আবারো বড় মহাপুরুম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে শেষ হয়।
—————
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।