ইউরোপের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহ

0

।। উবাই মারমা ।।

প্রথম পর্ব
ইউরোপে ঊনিশ শতকে ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ এই তত্ত্বের ভিত্তিতে নতুন জাতি-রাষ্ট্র গঠিত হলেও দেখা যায় প্রত্যেক দেশের (ক্ষুদ্রতম দেশগুলো বাদে) ভৌগলিক সীমানার মধ্যে সংখ্যালঘু জাতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফলে ইউরোপের দেশগুলো মূলতঃ এক-জাতি রাষ্ট্রের পরিবর্তে বহুজাতিক রাষ্ট্রের রূপ নেয়। প্রথমদিকে এই সংখ্যালঘু জাতিগুলোর স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে নতুন রাষ্ট্রের জন্য হুমকী মনে করা হলেও পরে দেখা যায় এই ব্যবস্থাই রাষ্ট্রের ঐক্য, সংহতি ও অখ-তার জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়েছে। ফলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর জন্য বিভিন্ন মাত্রার স্বায়ত্তশাসন প্রদান শুরু হয়।

ইউরোপে বর্তমানে কোন কোন সংখ্যালঘু এলাকায় স্বায়ত্তশাসনের পরিধি এত ব্যাপক যে, সে এলাকাগুলো প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন রাষ্ট্রের মতোই। অনেকে একে ‘রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে ইউরোপের সংখ্যালঘু জাতির জনগণের এই স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জিত হয়েছে ধীরে ধীরে। মূলতঃ দেখা যায়, যে রাষ্ট্র ও সমাজ যত বেশী গণতান্ত্রিক সেই রাষ্ট্র ও সমাজে নারী ও সংখ্যালঘু জাতির জনগণ তত বেশী অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। সেজন্য একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নারী ও সংখ্যালঘু জাতির জনগণ কতটুকু অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করেন তাই হলো সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের মাপকাঠি। কাজেই বলা যায় গণতান্ত্রিক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের পত্তনই ইউরোপে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের স্বায়ত্তশাসনের মূল ভিত্তি। আমরা এখানে ইউরোপের কয়েকটি দেশের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথম পর্বে ফিনল্যান্ডের আলান্ড দ্বীপ।

আলান্ড দ্বীপপুঞ্জ, ফিনল্যান্ড (The Aland Island, Finland)
কম করে হলেও ৬,৫৫৪টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে আলান্ড দ্বীপপুঞ্জ গঠিত যার আয়তন ৬,৭৮৪ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে কেবল ৫০ টিতে স্থায়ী বসবাস রয়েছে। ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা ২৬,৭১১ জন। সরকারী ভাষা সুইডিশ। রাজধানীর নাম মেরীহান (Mariehamn)।

aland_islandস্বরণাতীত কাল থেকে আলান্ড সুইডেনের অংশ হলেও, ইতিহাসের ঘটনাচক্রে ১৮০৯ সালে তা রাশিয়ার হাতে চলে আসে। তৎকালীন রাশিয়ার অধীন ফিনল্যান্ডের গ্রান্ড ডাচির অংশ হিসেবে সুইডিশভাষী আলান্ডবাসীরা তখন কতিপয় সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করতো। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর ফিনল্যান্ড স্বাধীনতা লাভ করলে আলান্ড তার ভৌগলিক অংশে পরিণত হয়।

সুইডেন আলান্ডের স্ট্যাটাসের এই পরিবর্তনের বিরোধীতা করে। পরে ১৯২০ সালে লীগ অব ন্যাশনস বিষয়টি নিষ্পত্তি করে এবং ফিনল্যান্ড আলান্ডবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য রক্ষার এবং স্বায়ত্তশাসিত ও বেসামরিকায়ন এলাকার মর্যাদা (Demilitarized and Autonomous status) ভোগ করার অধিকার স্বীকার করে নেয়। একই বছর ফিনিশ সংসদ আলান্ডের স্ব-প্রশাসন আইন অনুমোদন করে, যার ফলে ইউরোপে প্রথম সরকারীভাবে স্বায়ত্তশাসিত এলাকা গঠিত হয়। সাবেক ”রক্ষণ শক্তি”( Protection Power) হিসেবে রাশিয়া এই ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয়। বর্তমানে আলান্ডকে পৃথিবীর রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের সবচেয়ে অগ্রসর পদ্ধতিগুলোর একটি বলে বিবেচনা করা হয়।

আলান্ডের স্ব-প্রশাসন আইনটি (Self Administration Law) বেশ কয়েক বার সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ১৯৯১ সালের ১৬ আগষ্ট। এই আইনটিকে “Autonomy Act”ও বলা হয়। আলান্ডের আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ৩০ সদস্যের এক কক্ষ বিশিষ্ট প্রতিনিধি সভার হাতে, যা ল্যান্ডস্টিংগ (Landsting) নামে পরিচিত। প্রতিনিধিরা চার বছরের জন্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। এছাড়া স্থানীয় সংসদ ছাড়াও ফিনিশ জাতীয় পার্লামেন্টের একটি আসন রয়েছে আলান্ডে। আলান্ডের সংসদ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে বিশেষভাবে সংরক্ষিত বিষয়গুলো ছাড়া বাকী সব বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সংরক্ষিত বিষয়গুলো হলো সংসদীয় আইন, বৈদেশিক সম্পর্ক, সাধারণ কর ও পরিশোধ, ফৌজদারী ও অধিকাংশ দেওয়ানী আইন, বিচার বিভাগ, সামাজিক বীমা, নৌ পরিবহন ও বিমান এবং যোগাযোগ। অপরদিকে যে সকল ক্ষেত্রে আলান্ডের ক্ষমতা রয়েছে সেগুলো হলো সাংস্কৃতিক বিষয়াদি, স্বাস্থ্য ও হাসপাতাল, শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, পেশার নিয়ন্ত্রণ, গৃহ ও সমাজ কল্যাণ, সংরক্ষণ, গণ বিনোদন এবং জন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। আলান্ডের সংসদ-এর ক্ষমতা এতদূর বিস্তৃত যে, তারা আলান্ড দ্বীপের ব্যাপারে আইন প্রণয়নের জন্য হেলসিংকি পার্লামেন্টে সরাসরি প্রস্তাব জানাতে পারে, এমনকি সেই আইন কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সংরক্ষিত বিষয়ে হয়ে থাকলেও। অপরদিকে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলান্ড সরকারের প্রণীত আইনে ভেটো দিতে পারেন, যদি তিনি সুপ্রীম কোর্ট অথবা আলান্ড কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে মনে করেন যে, উক্ত আইন ফেডারেল সরকারের জন্য সংরক্ষিত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে অথবা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বা বহির্ভাগের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। আলান্ড কমিশন আলান্ড সরকার ও হেলসিংকির কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টের ল্যান্ডস্টিংগ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেয়ারও ক্ষমতা রয়েছে। আলান্ডে ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হলেন একজন গভর্ণর, যিনি ল্যান্ডস্টিংগ-এ নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্য থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। আলান্ডে নির্বাহি ক্ষমতা থাকে একজন প্রধানমন্ত্রীর হাতে।

আলান্ডে পৃথক বিচারিক ব্যবস্থা নেই। দ্বীপবাসীরা বিচার প্রশাসনের জন্য ফিনল্যান্ডের মিউনিসিপ্যাল ও জেলা আদালত এবং সুপ্রীম কোর্টের উপর নির্ভর করে থাকেন। আলান্ড দ্বীপের অর্থ ব্যবস্থা পরিচালনা করে ল্যান্ডস্টিংগ ও যৌথ আলান্ড আইল্যান্ড কমিশন। স্বায়ত্তশাসিত সরকার খরচের অধিকাংশ অর্থ নিজেই যোগান দেয় এবং আয়ের উপর কর আরোপের ক্ষমতা রাখে। ল্যান্ডস্টিংগ বার্ষিক বাজেট ঠিক করে এবং কর ও চার্জ আদায়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে। জয়েন্ট আলান্ড আইল্যান্ড কমিশন হেলসিংকি কর্তৃক আলান্ডকে দেয়া অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করে।

ফিনল্যান্ড আলান্ডে গতানুগতিক জাতীয় কর এবং শুল্ক সংগ্রহ করে থাকে, তবে ফিনল্যান্ডের মোট রেভিনিউর .৪৫% আলান্ডে ফিরে আসে। ল্যান্ডস্টিংগ দ্বীপের বার্ষিক বাজেট কোন খাতে ব্যয় হবে তা স্বাধীনভাবে ঠিক করতে পারে। স্বায়ত্তশাসন ও সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থার কারণে আলান্ডের অর্থনীতি স্থিতিশীল ও জীবন মান অত্যন্ত উচুঁ।

ভাষানীতি সম্পর্কে বলা যায়, ফিনল্যান্ড সুইডিশ ও ফিনিশ এই দুই ভাষাকে সরকারী রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এতে আবার সুইডিশ ভাষাকে বিশেষ সুবিধাভোগীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এর ফলে ফিনল্যান্ডের যেখানে সুইডিশ-ভাষী সংখ্যালুঘুরা রয়েছেন সেখানে উন্নত দ্বিভাষী ব্যবস্থা (system of bilingualism) চালু করা হয়েছে। অপরদিকে আলান্ডে সরকারী ভাষা হলো সুইডিশ এবং প্রশাসন চালানোর একমাত্র ভাষাও সুইডিশ। আলান্ডের সরকারী কর্মচারীদেরকে অবশ্যই বাধ্যতামূলকভাবে সুইডিশ ভাষায় লেখনে ও কথনে পারঙ্গম হতে হয়। স্কুলে পাঠদানের মাধ্যম হলো সুইডিশ, ইংরেজি বাধ্যতামূলক বিষয় এবং ফিনিশ, জার্মান ও অন্যান্য ভাষাগুলো ”বিদেশী ভাষা” হিসেবে ঐচ্ছিক।

আলান্ডের স্থায়ী অধিবাসী অথবা ৫ বছর ধরে আলান্ডে বসবাসকারী অ-আলান্ডী ফিনিশরা আলান্ড দ্বীপের নাগরিকিত্ব পাওয়ার অধিকারী। অ-আলান্ড নাগরিকদের সেখানে জমি কেনার ও ব্যবসা বাণিজ্য চালানোর অধিকার না দেবার ক্ষমতা আলান্ডের রয়েছে। আলান্ড দ্বীপের নাগরিকদের দ্বৈত নাগরিকত্বের (আলান্ড ও ফিনিশ) অধিকার রয়েছে এবং তারা ফিনল্যান্ডের রাজনীতিতে স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, যদিও ফিনল্যান্ডের বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব থেকে তারা মুক্ত।

১৯৭৫ সাল থেকে আলান্ড স্ক্যান্ড্যানেভিয়ান দেশসমূহ ও ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপগুলোসহ একসাথে ও একই মর্যাদায় নর্ডিক কাউন্সিলের সদস্য। আলান্ড ১৯৯৫ সালে স্বাধীনভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়া বা না দেয়ার সিদ্বান্ত গ্রহণ করেছিল। এখনো ইইউর কতিপয় রেগুলেশন যেমন কাস্টম ইউনিয়ন আলান্ডে প্রযোজ্য নয়, এবং আলান্ড স্বাধীনভাবে ইইউর একক রেগুলেশন থেকে বের হয়ে যেতে পারবে। আলান্ডের স্বায়ত্তশাসন ধাপে ধাপে বিস্তৃত হয়ে বর্তমানে এমন সীমায় পৌঁছেছে, যাকে ”রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র”( state in a state) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। আলান্ড বলতে গেলে অল্পের জন্য স্বাধীন নয়। বহু দশক ধরে আলান্ড বেসামরিকায়িত: যেখানে কোন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন অথবা সামরিক সদস্যের অবস্থান নিষিদ্ধ। [প্রথম পর্ব সমাপ্ত]

Source: The working autonomies in Europe by Thomas Benedikter
——————-

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More