চতুর্থ পর্ব

ইউরোপের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহ

0

।। উবাই মারমা ।।

চতুর্থ পর্ব
ইউরোপের কয়েকটি দেশের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা সম্পর্কে এখানে ধারাবাহিকভাবে যে আলোচনা করা হচ্ছে আজকে তার চতুর্থ পর্বে স্পেনের ক্যাটালোনিয়া ও বাস্ক।

ক্যাটালোনিয়া ও বাস্ক, স্পেন (Catalonia and Basque, Spain)
সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের প্রক্রিয়ায় একটি একক বা এককেন্দ্রীক রাষ্ট্র থেকে ফেডারেল রাষ্ট্রে রূপান্তরের উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত হলো স্পেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যকে একত্রিত করে স্পেন প্রথম একটি একক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সপ্তদশ শতাব্দীতে কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে ক্যাটালোনিয়া, আন্দালুসিয়া, অ্যারাগোঁ, নেপলস ও সিসিলিতে সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হয়, তবে এই যুদ্ধে কেন্দ্র্রীয় সরকার বিজয় লাভ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে স্পেনের রাজা পঞ্চম ফিলিপ অস্ট্রিয়ার আর্ক ডিউক চালর্স-এর বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই অস্ট্রিয়া বাহিনীতে ক্যাটোলিনিয়া ও অ্যারাগোঁর বাহিনীও ছিল। পরাজয়ের পর ফিলিপ তখনো বর্তমান স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধীরে ধীরে অকেজো করে দেন। স্থানীয় ক্ষমতার এই হ্রাসকরণের প্রক্রিয়া ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চলে। ১৯১৪ সালে মাদ্রিদ সরকার প্রদেশগুলোতে কিছু ক্ষমতা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণে রাজী হয়। ১৯৩১ সালে স্পেনে প্রজাতন্ত্র গঠিত হওয়ার পর দেশের সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। স্পেনের সংসদ কোর্টেস ১৯৩২ সালে ক্যাটালোনিয়া স্বায়ত্তশাসনের আইন অনুমোদন করে। ক্যাটালোনিয়াকে এই আইনের মাধ্যমে নিজস্ব আইন প্রণয়নের ক্ষমতাসহ ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছিল।

catalonia_in_spain

ক্যাটালোনিয়ার চাইতে বাস্ক সম্প্রদায় অধিক বিভক্ত, সে কারণে প্রথম দিকের বহু স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। কারণ স্পেনের সংসদ কর্তৃক স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব পাসের পূর্বে স্থানীয় জনগণের দ্বারা তা গণভোটে অনুমোদিত হওয়ার বিধান ছিল। অবশেষে ১৯৩৬ সালে বাস্ক স্বায়ত্তশাসন আইন পাস হয়, তবে ১৯৩৮ সালে স্বৈরাচারী জেনারেল ফ্রাঙ্কো স্পেনে ক্ষমতা দখলের কারণে তা বলবৎ হয়নি।

জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর সরকার ১৯৭৫ সালে তার মৃত্যর আগ পর্যন্ত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে রাষ্ট্রের প্রতি হুমকি মনে করে নির্দয়ভাবে দমন করেন। তিনি বাড়ির বাইরে ক্যাটালান ও বাস্ক ভাষা ব্যবহার ও শিক্ষা নিষিদ্ধ করেন; শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেন এবং স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাদেরকে এলাকার বাইরে থেকে নিয়ে আসেন।

ফ্রাঙ্কোর এই নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্যাটালোনিয়া ও বাস্কে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠে। ১৯৫০ দশকের শেষ ও ৬০ দশকের প্রথম দিকে বাস্কে গেরিলা দল ETA ( Euskadi  Ta Akatasuna, Basque Homeland and Freedom ) জন্ম লাভ করে। বাস্কে গেরিলা পদ্ধতিতে আন্দোলন হলেও ক্যাটালোনিয়ায় মূলত কমিউনিটি ভিত্তিক শক্তিশালী গণ প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। ফ্রাঙ্কোর পর এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে স্পেন পরম কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা থেকে বিশালাকারে বিকেন্দ্রীক হয়ে যায় এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে ১৭টি অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য আইন করা হয়।

স্পেনীশ সংবিধানে স্বায়ত্তশাসনের নীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় ১৯৭৮ সালে। এই সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:

”The Constitution is based on the indissoluble unity of the Spanish nation, the common and indivisible homeland of all Spaniards, and recognizes and guarantees the right to autonomy of the nationalities and regions which make it up and the solidarity among all of them.”

৩ ও ৪ নং অনুচ্ছেদে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোকে তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা ও পতাকা নির্দিষ্ট করার অধিকার ্েদয়া হয়েছে। আর স্বায়ত্তশাসিত এলাকার মর্যাদা লাভের বিস্তারিত শর্ত এবং স্বায়ত্তশাসিত ও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে ১৪৩ – ১৫৮ অনুচ্ছেদসমূহে।

স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত আইনগুলো (statutes) পরিবর্তন করতে হলে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সংসদ ও কেন্দ্রীয় সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় (absolute majority দ্বারা )। স্বায়ত্তশাসিত সরকারগুলোকে যেসব বিষয়ে বিস্তৃত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেগুলো হলো : স্থানীয় সরকার গঠন, স্থানীয় দেওয়ানী আইন, পাহাড়-পর্বত, বন, কৃষি, পশুপালন, মৎস্য, অভ্যন্তরীণভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্টন ও সরবরাহ; নগর পরিকল্পনা, গণ পূর্ত, স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মালিকানাধীন সরকারী সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ, বাসস্থান, সমাজ কল্যাণ, রাস্তাঘাট, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও শিল্প ( কিছু ব্যতিক্রম বাদে ), সংস্কৃতি ইত্যাদি। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সুস্পষ্টভাবে সংরক্ষিত নয় এমন বিষয়ের ক্ষমতাও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে প্রদান করা যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নিম্নোক্ত বিষয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রাখা হয়: ইমিগ্রেশন, বৈদেশিক সম্পর্ক, জাতীয় নিরাপত্তা এবং সামরিক বিষয়, বিচার প্রশাসন, শুল্ক, ফৌজদারী ও শ্রম আইন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সাধারণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সমন্বয় সাধন, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি, ইত্যাদি।

সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে কেন্দ্রীয় সরকারকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহের আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক ক্ষমতা (Legislative powers and administrative authoriy) হস্তান্তর করার এক্তিয়ার দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক স্বায়ত্তশাসিত এলাকার নিজস্ব বিচারিক ব্যবস্থা রয়েছে, যা সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত। দেওয়ানী মামলা এবং কতিপয় ফৌজদারী মামলার বিচার করার এখতিয়ার তাদের দেয়া হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে স্থাপিত উচ্চ আদালতে স্থানীয় মামলার আপীল শুনানীর ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের কাজ কর্মের বিরুদ্ধে শুনানীর এক্তিয়ারও এসব আদালতের রয়েছে।

বাস্ক ও ক্যাটালোনিয়ায় স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত সংসদ যথাক্রমে বাস্ক ও ক্যাটালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, স্থানীয় বাজেটের অনুমোদন দেয় এবং জাতীয় সিনেট সভায় তাদের অঞ্চলের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে। নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ হয় প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বাধীন একটি নির্বাহী পরিষদের মাধ্যমে। প্রেসিডেন্ট একই সাথে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের এবং সরকারের প্রধান।  নির্বাহী পরিষদ কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থেকে স্বাধীন এবং রাজনৈতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত সংসদের কাছে দায়বদ্ধ।Basgue map

বাস্ক ও ক্যাটালান স্বায়ত্তশাসন আইনে ‘‘স্বায়ত্তশাসিত পুলিশী ব্যবস্থার’’ বিধান রাখা হয়েছে, যার দায়িত্ব হলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা । তবে স্থানীয় পুলিশ বাহিনী ও জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি “নিরাপত্তা পরিষদ” রয়েছে। দু’টি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করতে পারে: এক. স্বায়ত্তশাসিত সরকারের অনুরোধে, দুই. এক তরফাভাবে স্বায়ত্তশাসিত সরকারের অনুরোধ ব্যতিরেকে; তবে “নিরাপত্তা পরিষদের” সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদনক্রমে ( স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের সম সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে এই নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত )।

স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলো একে অপরের সাথে চুক্তি করতে পারে, তবে এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ কোর্টেসকে (Cortes) কেবল নোটিশ প্রদান করতে হয় অথবা বিশেষ ক্ষেত্রে তার পুর্বানুমতি নিতে হয়। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলো সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুরোধ জানাতে পারে।

স্প্যানিশ ও বাস্ক অথবা ক্যাটালান হলো এই দুই স্বায়ত্তশাসিত এলাকার সরকারী ভাষা। উভয় ভাষাই মুক্তভাবে ও বৈষম্যহীনভাবে ব্যবহার করা যায়। উভয় ভাষা যাতে পড়ানো হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব হলো স্বায়ত্তশাসিত সরকারের।

স্প্যানিশ সংবিধান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহকে “আর্থিক স্বায়ত্তশাসন” প্রদান করেছে। স্বায়ত্তশাসিত সরকারের আয়ের উৎস হলো স্থানীয় কর ও রাষ্ট্রের সাধারণ আয়ের একটি অংশ।

বাস্ক: বাস্ক দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপে পাইরেনিস (Pyrenees ) পর্বতের পশ্চিম কোণায় অবস্থিত। এর জনসংখ্যা ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২১,২৪,৮৪৬ জন। আয়তন ৭,২৩৪ বর্গ কিলোমিটার। রাজধানীর নাম ভিক্টোরিয়া-গাসটিজ (Victoria-Gasteiz )। সরকারী ভাষা বাস্ক ও স্প্যানিশ।

ক্যাটালোনিয়া: ৩২,১০৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে ক্যাটালোনিয়া গঠিত। এর জনসংখ্যা সরকারী হিসেবে ৭৫,০৪,০০৮ জন (২০১৫ )। ক্যাটালান ও স্প্যানিশ দুই ভাষাই সরকারীভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ভ্যাল-ডি-আরান-এলাকায় মাত্র ৭,০০০ জন মানুষের ভাষা আরানীজকে (Aranese) এবং ১৮,০০০ জন লোকের ব্যবহৃত ক্যাটালান সাইন ল্যাংগুয়েজকে (Catalan sign language) সরকারী স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যে ক্যাটালানই ১৯৭৯ সালে স্বায়ত্তশাসন আইন বলে “ক্যাটালোনিয়ার নিজস্ব ভাষা” হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।

সূত্র: ১. Autonomy, Sovereignty, and Self-determination, Revised Edition (1996 ) by Hurst Hannum
২. The Working Autonomies in Europe by Thomus  Benedikter.
৩. Wikipedia
——————–

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More