অস্টম পর্ব

ইউরোপের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহ

0

।। উবাই মারমা ।।

ইউরোপের কয়েকটি দেশের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা সম্পর্কে এখানে ধারাবাহিকভাবে যে আলোচনা করা হচ্ছে আজকে তার অষ্টম পর্বে বেলজিয়ামের জার্মান সম্প্রদায়।

অস্টম পর্ব:
বেলজিয়ামের জার্মান সম্প্রদায়
২০০৫ সালের হিসাব মতে বেলজিয়ামে জার্মান-ভাষীর সংখ্যা আনুমানিক ৭২,০০০ জন। ৮৯৪ বর্গমাইল এলাকায় তাদের বসবাস। রাজধানীর নাম ইউপেন (Eupen)। সরকারী ভাষা জার্মান ও ফ্রেঞ্চ। ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে।

EUPEN

ইতিহাস
বেলজিয়ামের জার্মান-ভাষী সম্প্রদায় হলো বেলজিয়ামের তথাকথিত পূর্ব ক্যান্টনের (East Canton) প্রধান অংশ। এ এলাকাটি বেলজিয়ামের লিয়েজ প্রদেশের (Province of Liege) অন্তর্গত। নয়টি পৌরসভায় বসবাসরত ৭২,০০০ অধিবাসীর প্রায় সবার মাতৃভাষা হলো জার্মানী। পূর্ব ক্যান্টন জার্মানভাষী সম্প্রদায়ের এলাকা এবং ফ্রেঞ্চভাষী দুই মিউনিসিপ্যালিটি ম্যালমেডি ও ওয়েইমেস (Malmedy and Waimes) নিয়ে গঠিত। ১৯২০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলটি ইউপেন ও ম্যালমেডি জেলা নামে জার্মানীর রাইন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রথম বিশ^যুদ্ধে জার্মানীর পরাজয় ও পরবর্তীতে ভার্সাই চুক্তির পর বেলজিয়াম এই দুই জেলা দখল করে নেয়। এ কারণে এ এলাকাগুলো উদ্ধারকৃত ক্যান্টন বা পরে “ইষ্টার্ণ বেলজিয়াম” বা “জার্মান বেলজিয়াম” নামে পরিচিতি লাভ করে।

ভার্সাই শান্তি চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে, বেলজিয়ামের জার্মান-ভাষীদের রাজনৈতিক মর্যাদা কী হবে সে সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের মতামত নিতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় তা ঠিকভাবে হয়নি। তার বদলে যারা বেলজিয়ামের নাগরিক হতে চায় না এবং যারা চায় এলাকাটি জার্মানীকে ফেরত দেয়া হোক তাদেরকে পূর্ণ নাম ঠিকানাসহ রেজিষ্ট্রেশন করতে বলা হয়। এই পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে বেলজিয়ামের সামরিক প্রশাসন সুষ্ঠু ও স্বাধীন গণভোট অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করে। কারণ অনেক স্থানীয় অধিবাসী নাম জমা না দিলে সরকার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে, এমনকি এলাকা থেকে বহিস্কার করতে পারে এমন আশঙ্কায় ভীত ছিলেন। ১৯২০ দশকে জার্মানী ও বেলজিয়ামের মধ্যে এ অঞ্চলটি বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং তখন মনে হয়েছিল বেলজিয়াম এলাকাটি জার্মানীর কাছে বিক্রি করে দিতে আগ্রহী। এই অবস্থায় ফরাসী সরকার হস্তক্ষেপ করে, কারণ সেখানে ফ্রেঞ্চভাষী লোকজনও রয়েছে। এর পর বেলজিয়াম ও জার্মানীর মধ্যে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় বিশ^ যুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালে জার্মানী এই এলাকাটি পুনর্দখল করে নেয়। পূর্ব ক্যান্টনের (জেলা) জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই পুনর্দখলকে স্বাগত জানায়, কারণ তারা নিজেদেরকে জার্মান বলে মনে করে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধে জার্মানীর পরাজয়ের পর বেলজিয়াম ক্যান্টনগুলোকে আবার নিজের দেশের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এরপর নাৎসী জার্মানীর সাথে সহযোগিতার অভিযোগে বেলজিয়াম স্থানীয় জনগণকে ‘অ-জার্মানীকরণের’ (un-Germanize) একটা প্রচেষ্টা চালায়।

স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা
বেলজিয়ামের জার্মান সম্প্রদায় একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে। বেলজিয়ামের সংবিধানের ২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বেলজিয়াম তিনটি সম্প্রদায় (জাতি) নিয়ে গঠিত: জার্মান, ফ্লেমিশ এবং ফ্রেঞ্চ। এই তিন সম্প্রদায় সকল ‘ব্যক্তি-সম্পর্কিত-সেবার’ যেমন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক নীতি, সাংস্কৃতিক স্থানসমূহের সংরক্ষণ, পারিবারিক ও সামাজিক সহযোগিতা, স্বাস্থ্য এবং চাকুরিতে নিয়োগের নীতিমালার ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।

ফেডারেল রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসিত সত্তা হিসেবে এই তিন সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংসদ, সরকার ও মন্ত্রণালয় রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে তারা ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। পূর্ব ওয়ালোনিয়ার (Wallonia) নয়টি মিউনিসিপ্যালিটি নিয়ে জার্মান-ভাষী অঞ্চল গঠিত। সকল অঞ্চলসমূহে গণপ্রশাসন, স্কুল ও আদালতে সরকারী ভাষা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। জার্মান সম্প্রদায়ের অঞ্চলে ফরাসী ভাষীদের জন্য বিশেষ ভাষা সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। একইভাবে পার্শ্ববর্তী দুটি ফরাসী ভাষী অঞ্চলে জার্মান ভাষীদের জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষায় ভাষার মাধ্যম নির্ধারণ করার ক্ষমতা জার্মান সম্প্রদায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে জার্মান সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়া বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তাদেরকে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা বলে তারা বিদেশের সাথে চুক্তি ও সহযোগিতার শর্ত ঠিক করতে পারে। ২০০৫ সালে জার্মান সম্প্রদায় মিউনিসিপ্যালিটিগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও অডিটের ভার গ্রহণ করে।

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব
বেলজিয়ামের জার্মান সম্প্রদায় তিন স্তরে প্রতিনিধিত্ব করে। এক. জার্মানভাষী অঞ্চলটি লিয়েজ-এর ওয়ালুন আসনের সাথে যুক্ত। সে কারণে জার্মান-ভাষীরা বেলজিয়ামের সংসদে আলাদা একটি সংসদীয় আসনের দাবি জানিয়ে আসছে। জার্মান সম্প্রদায়ের সংসদ বেলজিয়াম পার্লামেন্টের দ্বিতীয় কক্ষ সিনেটে একজন সদস্য প্রেরণ করে থাকে। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত কোন জার্মান-ভাষী সদস্য সিনেটে নেই, কারণ নির্বাচিত করার মতো যথেষ্ট জার্মান ভোটার নেই। দুই. আঞ্চলিক স্তরে ওয়ালুন আঞ্চলিক সংসদে জার্মান সম্প্রদায়ের ৩ জন সদস্য রয়েছে। তবে জার্মান ভোটারদের জন্য বিশেষ আসন বরাদ্দ নেই। লিয়েজ প্রদেশে জার্মানরা বর্তমানে ৬ জন সদস্য নিয়ে প্রাদেশিক সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে। তিন. ইউপেনে জার্মান সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদ অন্যান্য সম্প্রদায়ের সংসদগুলোর সাথে সমন্বয় কমিশনগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করে। তাছাড়া জার্মান সম্প্রদায়ের ইউরোপিয়ান সংসদ নির্বাচনে একটি আসন রয়েছে।

জার্মান সম্প্রদায়ের সুনির্দিষ্ট স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৪ সালে বেলজিয়াম রাষ্ট্রের এক কেন্দ্রীক রাষ্ট্র থেকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে রূপান্তরের কাঠামোর মধ্যে। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের সময় জার্মান কমিউনিটি তাদের ভাষার সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৪ সালে জার্মান সম্প্রদায়ের প্রথম সংসদ নির্বাচিত হয়। ১৯৮০ – ৮৩ সালে দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ফলে তাদের সংস্কৃতি বিষয়ক ক্ষমতা এবং ব্যক্তি-সম্পর্কিত সেবার বিস্তৃতি ঘটে। সেই সময় থেকে জার্মান-ভাষী এলাকার সংসদ সরাসরি সরকার গঠন করে আসছে। পরে তৃতীয় দফা রাষ্ট্রীয় সংস্কারের সময় জার্মান সম্প্রদায় সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ করে।

১৯৯০ দশকে জার্মান সম্প্রদায় অধিকতর ক্ষমতা লাভ করে। ১৯৯৩-৯৪ সালে ৪র্থ রাষ্ট্রীয় সংস্কার হাতে নেয়া হয়। এ সময় বেলজিয়ামের জাতীয় সংসদকে সংস্কার করে সিনেটে জার্মান-ভাষীদের সরাসরি প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হয়। একই সময়ে জার্মান সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিধিও সম্প্রসারণ করা হয়।

বর্তমানে বেলজিয়ামের জার্মান সম্প্রদায় বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানাচ্ছে। তারা চায় ফেডারেল বেলজিয়ামে তাদের এলাকাকে ফরাসী-ভাষী ওয়ালোনিয়া এবং ফ্লেমিশ অঞ্চলের সমমর্যাদা দেয়া হোক। যদি তাদের দাবি পূরণ হয় তাহলে তাদের অঞ্চলটি হবে বেলজিয়ামে চতুর্থ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (বর্তমানে স্বায়ত্তশাসিত জেলা?)। অন্য তিনটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হলো Flanders, Brussels, এবং Wallonia ।

সূত্র:
১. The Working Autonomies in Europe by Thomus Benedikter.
———————

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More