ইতিহাসের এ দিনে (১৫ আগস্ট ১৯৪৭) : ব্রিটেনের ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ নামিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত ও বার্মার পতাকা উত্তোলন
সিএইচটি নিউজ ডটকম
৬৮ বছর আগে এদিনে (১৫ আগস্ট ১৯৪৭) অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজধানী রাঙ্গামাটিতে স্নেহ কুমার চাকমা (স্নেহবাবু)-এর নেতৃত্বে ব্রিটেনের ইউনিয়ন জ্যাক-এর পরিবর্তে ভারতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ আলোচিত অধ্যায় হয়ে রয়েছে। তৎকালীন ইংরেজ জেলা প্রশাসক কর্ণেল জি. এল. হাইড নিজেও উক্ত পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পতাকায় স্যালুট করেন। পরে কর্ণেল হাইড নিজের দপ্তরেও আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। অন্যদিকে বান্দরবান সদরে বোমাং রাজ পরিবারের উদ্যোগে বার্মার পতাকা উত্তোলিত হয়।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটি’ (একশন কমিটি) আগের দিন অর্থাৎ ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় (জিরো আওয়ার) ডিসি বাংলোতে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাকের পরিবর্তে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করতে চেয়েছিল। স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে ১০,০০০ যুবক মিছিল সহযোগে ডিসি বাংলোতে গিয়ে কর্ণেল হাইডকে ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কর্ণেল হাইড তাতে সম্মতি প্রকাশ করলেও ‘ব্রিটিশ রীতিতে সূর্যোদয়ের সময়ই পতাকা উত্তোলন করতে হয়’ বলে পরের দিন ১৫ আগস্ট ভোরে রাঙ্গামাটি ফুটবল মাঠে (পুরাতন কোর্টবিল্ডিং মাঠ) পতাকা উত্তোলনের কথা বলেন এবং তিনি নিজেও তাতে অংশ নেবেন বলে তাদের কথা দেন।
(দেখুন The Partition & The Chakmas and Other writings of Sneha Kumar Chakma, Edited by D.K.Chakma, pages : 4, 41)
১৯ আগস্ট ডিসি বাংলোতে ডিসি কর্ণেল হাইড-এর উপস্থিতিতে চাকমা রাজাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের প্রধান সিরিল র্যাডক্লিফ-এর পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তির সিদ্ধান্ত না মানার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সে প্রস্তাব মোতাবেক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে স্নেহ কুমার চাকমা ৮ জন সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে শক্তি সংগ্রহের লক্ষ্যে রামগড় হয়ে ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। এদিকে পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট কর্তৃক ২০ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল হলে তিনি আর স্বদেশে ফিরতে পারেন নি। ভারতে স্নেহবাবু প্রধানমন্ত্রী জওহুর লাল নেহেরুসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নিকট ধর্ণা দিয়েও তেমন সাড়া পান নি। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে পাকিস্তান বিরোধী নেতা-কর্মীগণ জীবনের ভয়ে ভারত ও বার্মায় আশ্রয় নেন। যারা দেশ ছেড়ে যান নি, তারা পাকিস্তান সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়ে নির্যাতনের শিকার হন।
স্নেহ কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন স্বনামধন্য জাতীয় রাজনৈতিক নেতা। ১৯১৪ সালে খাগড়াছড়ির খবংপুজ্জ্যা গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হওয়া এবং প্রতিবাদী বৈশিষ্ট্যের কারণে স্কুল জীবনেই তিনি জেল খাটেন এবং আজীবন পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর অধিকারের সপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল।
‘১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন’ (১৮ জুলাই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত) মোতাবেক দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে পাকিস্তান এবং মোটা দাগে হিন্দু ও অমুসলিমদের নিয়ে ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয়। সে সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের শতকরা ৯৮ ভাগের বেশি ছিল অমুসলিম। কাজেই স্বাভাবিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দিতে চায় নি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল বিনিময়ের প্রাক্কালে ছিটমহলবাসীদের তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলাদেশ বা ভারত রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বেছে নেবার অধিকার দেয়া হয়। সে মোতাবেক তারা নিজেদের পছন্দমত নাগরিকত্ব বেছে নেয়, একই পরিবারের স্বামী-স্ত্রী পর্যন্ত নিজ পছন্দমত দুই দেশের নাগরিকত্ব বেছে নিয়ে ভাগ হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো এই যে, ’৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় সিলেটসহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশে গণভোট হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে নিজেদের পছন্দমত রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বেছে নেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, যা চরম মানবিক অধিকার লঙ্ঘনও বটে।
এখানে প্রাসঙ্গিক কারণে উল্লেখ্য যে, ভারত বিভক্তিকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও মুক্তির স্বপ্ন লালন করেছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি’র (জনসংহতি সমিতি নয়) সভাপতি ছিলেন কামিনী মোহন দেওয়ান (গৌতম দেওয়ানের পিতামহ) আর সাধারণ সম্পাদক স্নেহ কুমার চাকমা। বয়োবৃদ্ধ কামিনী মোহন দেওয়ান স্বাস্থ্যগত ও নানা কারণে ভারত বিভক্তির সময় সিদ্ধান্তহীনতা ও হতাশায় ভুগছিলেন। সে অবস্থায় তরুণরা ১৯৪৭ সালের মে মাসে একটি সংগ্রাম কমিটি (একশন কমিটি) গঠন করে, যার সভাপতি প্রতুল চন্দ্র দেওয়ান আর ফিল্ড কমান্ডার ছিলেন ঘনশ্যাম দেওয়ান। এ সংগ্রাম কমিটি গঠনের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল স্নেহবাবুর ওপর। এ কমিটির নেতৃত্বেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাকের (ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা) পরিবর্তে ভারতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। #
————————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।