ইতিহাসের এ দিন : বেলুচ রেজিমেন্ট কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসন (২০ আগস্ট ১৯৪৭)

0

সিএইচটি নিউজ ডটকম
৬৮ বছর আগে এদিনটি (২০ আগস্ট) পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর জীবনে ছিল এক অভিশপ্ত দিন! পার্বত্যবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা গুড়িয়ে দিয়ে এদিন পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র আগ্রাসন চালায়। ব্রিটিশ শাসনের অন্তিম লগ্নে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কালে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সকালে রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা ও বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলন করা হয়। স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার। বোমাং রাজ পরিবারের নেতৃত্বে বান্দরবানবাসী বার্মার সাথে যুক্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু বেলুচ রেজিমেন্ট সশস্ত্র শক্তির জোরে রাঙ্গামাটির ডিসি অফিস ও কতোয়ালি থানা থেকে ভারতীয় পতাকা এবং বান্দরবান থেকে বার্মার পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে পুরোপুরি পাকিস্তানি দখল কায়েম হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয় এক অভিশপ্ত অধ্যায়, যার স্থায়ীত্ব ছিল প্রায় সিকি শতাব্দী পর্যন্ত (১৯৪৭ আগস্ট-১৯৭১ ডিসেম্বর)।

chtmapপার্বত্য চট্টগ্রাম একশন কমিটি (সংগ্রাম কমিটি) গঠিত হলেও রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে বেলুচ রেজিমেন্টের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোন সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি, এমনকী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, বয়কট-কালো পতাকা প্রদর্শন– সে ধরনের কোন কর্মসূচিও ছিল না। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম শিক্ষা-দীক্ষা রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় এবং সাংগঠনিক দিক থেকে ছিল অনেক পশ্চাৎপদ। একমাত্র গণসংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতিও (জনসংহতি সমিতি নয়) সাংগঠনিক শক্তির বিচারে ছিল অনেক দুর্বল এবং এর অনেক সীমাবদ্ধতাও ছিল। সে যুগে পাহাড়িদের মধ্যে পেশাদার রাজনীতি করার লোকও ছিল না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত ফ্রন্টিয়ার্স পুলিশ (পাহাড়িদের নিয়ে গঠিত) কর্ণফুলি নদী পথে প্রতিরোধের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বলে জানা যায়। কিন্তু উপযুক্ত প্রস্তুতি ও নেতৃত্বের অভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় নি। নদী পথই ছিল রাঙ্গামাটি অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কর্ণফুলি (বড়গাং) নদী দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রাম যেতে হতো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-প্রকৃতি বহিঃআক্রমণ প্রতিরোধে অনুকূল হলেও সংগঠন শক্তি, প্রস্তুতি ও নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট বলতে গেলে বিনা বাধায় সদর্পে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করতে সক্ষম হয়। ভারত ও বার্মার পতাকা উত্তোলিত হলেও লক্ষ্যণীয় ব্যাপার এই, এ দু’টি রাষ্ট্র কোনটিই তাতে বাধা দিতে এগিয়ে আসে নি। ভারতের শীর্ষ নেতা জওহর লাল নেহেরুসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা ছিলেন কাশ্মির সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম একশন কমিটির নেতা স্নেহ বাবু আক্ষেপ করে লিখেছিলেন আবেদনের ৫০ দিন পর তবেই তিনি নেহেরুর সাক্ষাত পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। ততদিনে কর্ণফুলির জল বহুদূর গড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে বার্মার কোন আগ্রহের কথাই জানা যায় নি।

পরিহাসের বিষয় এই, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাসকৃত ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন গোড়াতেই লংঘিত হয়েছে এবং তার হোতা ছিল খোদ ব্রিটিশ শাসকরাই। ভারত বিভক্তিকালে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী অসম সাহসী ও অগ্রসর শিখ জনগোষ্ঠীকে শান্ত রাখতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক কর্তাব্যক্তিগণ পার্বত্য চট্টগ্রামের সহজ সরল পশ্চাৎপদ পাহাড়ি জনগণকে বলি দেন। শিখ জনগোষ্ঠী বেঁকে বসলে ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে ধুরন্ধর ব্রিটিশ শাসকরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছিল।

পাঞ্জাবের দু’টি তহশিল (প্রশাসন ইউনিট) ফিরোজপুর ও জিরা এলাকায় মুসলিমরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫১%), অন্যদিকে শিখ জনগোষ্ঠী ছিল ৩৫%, ও হিন্দু ১৪%। সেই দিক থেকে সীমান্ত নির্ধারণের প্রাথমিক খসড়ায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে এ দু’টি এলাকা পাকিস্তানের ভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীন হবার দু’দিন পর চূড়ান্ত সীমান্ত নির্ধারণে এলাকা দু’টি ভারতের সাথে জুড়ে দেয়া হয়, যা খোদ জিন্নাহও মেনে নেন নি। পাকিস্তানের এ ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সম্পূর্ণ অন্যায় অযৌক্তিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়, তাও করা হয়েছিল স্বাধীনতার দু’দিন পরে।

তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়ায় চট্টগ্রামের উগ্রপন্থী মুসলিম লীগের নেতারা উল্লসিত হয়েছিল বলে জানা যায়। কথিত আছে, বেলুচ রেজিমেন্ট কর্তৃক রাঙ্গামাটি আগ্রাসনের পেছনে চট্টগ্রামস্থ মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা) সহ চট্টগ্রামের কতিপয় উগ্র মুসলিম লীগের নেতার যোগসাজশ ছিল। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ফ.কা. চৌধুরী গং ১৯৫৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের একটি সাধারণ জেলায় পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কিন্তু রাঙ্গামাটির তৎকালীন ইংরেজ জেলা প্রশাসক নিবলেট আর পাহাড়ি নেতাগণের প্রচেষ্টার ফলে সে ষড়যন্ত্র সফল হয় নি। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের চীন সফর কালে ফ. কা. চৌধুরী একদিনের জন্য পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হলে ঐদিনেই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের “বিশেষ অঞ্চলের” মর্যাদা খারিজ করে তার আগের ষড়যন্ত্র সফল করেন। পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম “বিশেষ অঞ্চলের” মর্যাদায় সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের কাশ্মির ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে শাসিত হতো, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা থেকে নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ অঞ্চলের মর্যাদা বাতিল করে দেয়ায় সে সময় অনেক প্রতিবাদ ও দেন দরবার করা হলেও পাকিস্তান আমলে আইনগতভাবে তা আর পুনঃস্থাপিত হয় নি, অনেকটা ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি “বিশেষ অঞ্চল” তা সংবিধানে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদী বাঙালি শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ি জনগণের জাতিসত্তার স্বীকৃতি না দিয়ে ঢালাওভাবে সবাইকে “বাঙালি” হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিএনপি’র শাসনামলে “বাংলাদেশী” বলা হলেও বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবার আগের ধারা ফিরিয়ে আনে। পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের যেটুকু অধিকার ও মর্যাদা স্বীকৃত ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে তাও অবশিষ্ট রইল না। ফলতঃ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, যা সশস্ত্র রূপও নেয়। ১৯৯৭ সালে ‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদিত হলেও এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী দমন-পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। অশান্ত অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে। সংগঠিত হচ্ছে প্রতিবাদও।#
———————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More