ইতিহাসে এই দিন : পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানি আগ্রাসন (২০ আগস্ট ১৯৪৭)

0

ইতিহাসে এই দিন
‘২০ আগস্ট’ পার্বত্যবাসীদের জীবনে এক কালদিবস! ১৯৪৭ সালের এদিন বেলুচ রেজিমেন্ট সশস্ত্র আগ্রাসন চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে। অন্যায় জবরদস্তিমূলকভাবে ‘ভারত স্বাধীন আইন ১৯৪৭’ লংঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূ-খণ্ডকে পাকিস্তান নামক এক ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ভাবনার বিষয় এই, বেলুচ রেজিমেন্ট এতে বড় কোন প্রতিরোধের মুখে পড়ে নি, এমনকী কোন গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ বিক্ষোভেরও (কাল পতাকা উত্তোলন, কালব্যাজ ধারণ, শান্তিপূর্ণ বয়কট) সম্মুখীন হয় নি। বলতে গেলে বিনা বাধায় বেলুচ রেজিমেন্ট প্রথমে রাঙ্গামাটি এবং পরে বান্দরবানে দখল কায়েম করতে সক্ষম হয়।

chtmapভাবতে অবাক লাগে, পৌনে দু’শত বছর (১৭৭২-১৯৪৭) আগে যারা একদিন ‘ব্রিটিশ সিংহ’-এর আগ্রাসন ঠেকিয়ে নিজেদের স্বাধীনসত্ত্বা টিকিয়ে রাখার গৌরবের অধিকারী, তারা কিনা বেলুচ রেজিমেন্টের মত একটি ‘ষাঁড়’কে প্রতিরোধ করলো না বা করতে পারলো না! পার্বত্যবাসীর প্রতিরোধ শক্তি কতটুকু লোপ পেয়েছিল ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়! তখনকার দিনে কর্ণফুলি নদী দিয়ে রাঙ্গামাটি যেতে হতো। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি পাকা সড়ক তখনও হয় নি বা যেটুকু কাঁচা রাস্তা ছিল, তাও ছিল ব্যবহার অনুপোযোগী। যতদূর জানা যায়, বেলুচ রেজিমেন্টের দলটিও আকারে বড় ছিল না। তখনকার দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল পাহাড়িদের নিয়ে গঠিত ফ্রন্টিয়ার পুলিশ, তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে নি। প্রতিরোধের লক্ষ্যে সলা-পরামর্শও হয় বলে জানা যায়। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব নানা সংশয়। বলিষ্ঠ উদ্যোগ আর সংগঠনের দুর্বলতা ছিল অত্যধিক। অথচ ১৫ আগস্ট ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় রাঙ্গামাটিতে সমবেশ ঘটেছিল দশ সহস্রাধিক যুবকের। অনুমিত হয়, বান্দরবানেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র-যুবকের সমাবেশ ঘটে থাকবে। সুসংগঠিত ও সমন্বিত উদ্যোগ গৃহীত হলে সন্দেহ নেই এ যুবশক্তি প্রলয় ঘটাতে পারতো! কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগ আর সংগঠনের দুর্বলতার কারণে বেলুচ রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা আর হয়ে উঠে নি। পরিণামে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর কাঁধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জায়গায় চাপিয়ে দেয়া হয় উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তানি শাসকদের জোয়াল।

জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে পার্বত্যবাসীদের এ ব্যর্থতা ও অক্ষমতার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করলে মূল হোতা হিসেবে বেরিয়ে আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীই। কূটকৌশল খাটিয়ে ধুরন্ধর ব্রিটিশরা স্বাধীন রাজ্যকে গ্রাস করে নিয়েছিল। পার্বত্যবাসীর প্রতিরোধ ও সাংগঠনিক শক্তি খর্ব করতে আরোপ করেছিল নানা বিধি-নিষেধ। ব্রিটিশ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগঠন ও রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা তো ছিলই, এমনকী ‘দা, তীর-ধনুক’ বহন আর জমায়েতেও ছিল নিষেধাজ্ঞা (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ‘১১দফা নির্দেশনা’ হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসনের ঘৃণ্য নজীর)। সাধারণ প্রজার সাথে রাজন্যবর্গের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে প্রবর্তন করেছিল নানা ধরনের ভাতা ও সম্মানি, যা এখনও ভিন্ন কৌশলে জারি রয়েছে। ভবিষ্যতে পার্বত্যবাসী যাতে সংগঠিত হয়ে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম না হয় সে লক্ষ্যে প্রয়োগ করেছিল ‘ভাগ করে শাসন করার’ সাম্রাজ্যবাদী কূটকৌশল। তারই পরিণতিতে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রায় সিকি শতাব্দিকাল ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী ছিল অসংগঠিত, অসচেতন ও পশ্চাদ অবস্থায়। ১৯৪৭ সালে বেলুচ রেজিমেন্টকে প্রতিরোধ করতে না পারার কারণ এখানেই নিহিত।

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন, বেলুচ রেজিমেন্ট নামে যে সৈন্যবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আগ্রাসন চালিয়েছিল, তাদের আবাসস্থল বেলুচিস্তান প্রদেশও পরবর্তীতে পাকিস্তানের দমন-পীড়নের শিকার হয়। খোদ বেলুচরাই এখন অভিযোগ করছে ‘১৯৭১-এ বাঙালিদের মত হত্যাকা-’ চলছে বেলুচিস্তানে। বেলুচিস্তানে শাসন করার কোন নৈতিক অধিকার পাকিস্তানের নেই বলে প্রতিবাদী বেলুচরা সভা-সেমিনারে বলে বেড়াচ্ছে। বেলুচরা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হতে চাইছে। ভবিষ্যতে কোন দিন কোন বেলুচ গবেষক যদি নৈর্ব্যক্তিকভাবে ইতিহাস অনুসন্ধান করেন, তাহলে এ সত্য উদঘাটিত হবে একদিন তাদের জাতির কতিপয় লোক (বেলুচ রেজিমেন্টভুক্ত) পার্বত্য চট্টগ্রামে আগ্রাসন চালিয়ে সহজ সরল পাহাড়িদের কাঁধে পাকিস্তানি দমন-পীড়নের জোয়াল তুলে দিতে ভূমিকা রেখেছিল, তার জন্য তারা নিশ্চয় লজ্জা পাবে, অনুশোচনা করবে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী যেভাবে এবরজিনদের (অস্ট্রেলিয়ার মূল অধিবাসী) নিকট অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন। এমন দিন আসবে যেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর দুর্দশার পেছনে নিজেদের দায়-দায়িত্বের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে পাহাড়ি জনগণের নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। পাকিস্তান সরকার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১-এ হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য বাংলাদেশের জনগণের নিকট ক্ষমা চায় নি, ক্ষমা চাওয়ার দাবি খোদ পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রবল হচ্ছে। যেদিন পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নিকট ক্ষমা চাইবে, সেদিন পার্বত্যবাসীর নিকটও ১৯৪৭ সালে আগ্রাসন চালানোর জন্য তাদের ক্ষমা চাইতে হবে।#

এ সংক্রান্ত আরো পড়ুন:
>> ইতিহাসের এ দিন : বেলুচ রেজিমেন্ট কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসন (২০ আগস্ট ১৯৪৭)

————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More