একান্ত সাক্ষাতকারে সন্তু গ্রুপ নেতা: ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করে কারোর লাভ নেই- একমাত্র জুম্ম জনগণের শত্রুদের ছাড়া

0
ছবি: প্রতীকী
ছবি: প্রতীকী

সাক্ষাতকার (অংশ – ২)
কিছুদিন আগে জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমা অংশের এক বিক্ষুদ্ধ নেতার সাথে সিএইচটি নিউজ ডটকমের এক সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হয়। বহু অনুরোধের পর তিনি এই সাক্ষাতকার দিতে সম্মত হন। তবে কতগুলো শর্তে: যেমন তার ছবি প্রকাশ করা যাবে না, সাক্ষাতকারটি অডিও-ভিডিও করা যাবে না, তবে হাতে নোট করা যাবে, এবং তার পরিচয় গোপন রাখা হবে ইত্যাদি। ভারত- বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় একটি গোপন স্থানে সাক্ষাতকারটি নেয়া হয়। সাক্ষাতকারে তিনি পার্টির আভ্যন্তরীণ বিষয়, আন্দোলনের কলাকৌশল, সন্তু লারমার নেতৃত্ব, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। তবে এখানে বিশেষ কারণে তার সম্পূর্ণ সাক্ষাতকারটি প্রকাশ না করে কেবল এ সময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো প্রকাশ করা হলো। আমাদের বিশ্বাস এতে জেএসএস সন্তু গ্রুপের বর্তমান অবস্থার চিত্র সম্পর্কে মোটামুটি একটা আভাস পাওয়া যাবে। দুই অংশে বিভক্ত করে নিচে সাক্ষাতকারটির শেষ অংশ পত্রস্থ করা হলো:

সিএইচটি নিউজ ডটকম: পার্টিতে আপনাদের সমর্থন কেমন?
বিক্ষুব্ধ সন্তু গ্রুপ নেতা: পার্টির ৯৯+৯৯% আমাদের সমর্থন করে। বাকি ০১% আমাদের সমর্থন নাও করতে পারে। সন্তু লারমা যাদেরকে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছেন তাদের অনেকের বয়স ৬০ এর উর্ধে। অনেকের ৫০ এর উপর। তারা যুদ্ধ করতে করতে এখন ক্লান্ত। তারা একে অন্যকে মেরে ফেলার মধ্যে জুম্ম জাতির কোন ভবিষ্যত দেখে না। আমাদের ক্যাডাররা আর আগ্রহ সহকারে জেএলএ-এর কাজে অংশ নেয় না। খোদ রাঙ্গামাটিতে অনেকে সন্তু লারমাকে প্রকাশ্যে সমালোচনাও করে থাকে। মূল কথা হচ্ছে, সন্তু লারমাকে বুঝতে হবে যে তার আর সময় নেই-তার বয়স এখন ৭৫। এখন তার দরকার অভিভাবকের মতো দায়িত্ব পালন করা। প্রতিদিন ফোনে কাকে কোথায় কিভাবে আক্রমন করতে হবে সে রকম নির্দেশ দেয়া নয়।

সিএইচটি নিউজ ডটকম: সন্তু লারমার বিরুদ্ধে আপনাদের পার্টিতে যে অসন্তোষ রয়েছে তা কেমন ব্যাপক?
বিক্ষুব্ধ সন্তু গ্রুপ নেতা: অসন্তোষ অনেক ব্যাপক। তিনি সিনিয়র নেতাদের কাউকে বিশ্বাস করেন না। এমপি উষাতন তালুকদারের পিএস তুহিন চাকমাকে ফরেন (এ্যাফেয়ার্স) বিভাগে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তুহিন ভালো, মেধাবী এবং স্বাধীন চিন্তার মানুষ। তবে এগুলোই হয়তো একদিন তার কাল হয়ে দাঁড়াবে। তুহিনকে একটা বিষয় থেকে শিক্ষা নিতে হবে-পার্থ চাকমাকে ফরেন বিভাগে দায়িত্ব না দিয়ে তাকে (তুহিন) দেয়া হয়েছে, কারণ সন্তু লারমা চান না পার্থর বাবা (লক্ষীপ্রসাদ চাকমা ওরফে দেবাশীষ) পার্টিতে বেশী ক্ষমতাশালী হোক। পার্থ বাব ও পার্থ-এর সাথে তার (সন্তু) রয়েছে রক্তের সম্পর্ক, তারা নিকট আত্মীয়। কাজেই সন্তু বাবু যদি তার নিজের রক্তকে বিশ্বাস না করেন তাহলে তুহিনকে আরো বেশী বিশ্বাস করবেন না। এটাই হলো আসল সত্য কথা।

তাছাড়া পার্টির প্রত্যেক সদস্য জানে আন্দোলনের ব্যাপারে, বৃহত্তর জুম্মজাতির স্বার্থের ব্যাপারে সন্তু লারমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। তিনি ১ মে থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবে বলে ঘোষণা দিলেন। কিন্তু কি করলেন? তিনি ডিজিএফআই ও আর্মির কাছ থেকে এক ব্যাগ টাকা নিলেন, আর তারপর হঠাৎ আন্দোলন শুরু না করেই বন্ধ করে দিলেন।

সিএইচটি নিউজ ডটকম: দেখা যাচ্ছে আপনি অনেক ভেতরের বিষয় জানেন, যা বাইরের লোকজন শুনলে অবাক হবে। কিন্তু সন্তু বাবু আপনাদের ভিডিও ধারণকে একটা ব্লাফ বলে উড়িয়ে দিতে চাইবেন।
বিক্ষুব্ধ সন্তু গ্রুপ নেতা: আমরা ব্লাফ মারি না। আমরা সন্তু লারমা যা করেন সবই জানি। সন্তু লারমা করেন এমন কিছু নেই যা আমরা জানি না । তিনি কখন টয়লেটে যান, কখন ব্যায়াম করেন তাও আমাদের জানা।

সিএইচটি নিউজ ডটকম: আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আপনাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কি?
বিক্ষুব্ধ সন্তু গ্রুপ নেতা: আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য স্পষ্ট- আমরা সবাই জুম্মদের অধিকারের জন্য লড়াই করছি। তবে এই সাক্ষাতকারের মাধ্যমে আমরা একটি বার্তা দিতে চাই। পার্টিতে প্রথমে গনতন্ত্র ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য সন্তু লারমাকে অবশ্যই জেএসএস-এর সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তিনি আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান থাকবেন এবং সেখানে থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সকল শক্তি ও মনোযোগ নিয়োজিত রাখবেন। যদি চুক্তি বাস্তাবায়নের জন্য সংগ্রাম করার মানসিকতা ও আস্থা তার না থাকে, তাহলে তিনি অবসর নেবেন। তিনি বিদেশে তার কন্যা ও নাতী নাতনীর সাথে সুখে বসবাস করতে পারেন। আমাদের পার্টি এম.এন লারমা গ্রুপের সাথে এক হয়ে যাবে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করবে। আমরা ইউপিডিএফকে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য ডাকবো। পার্টির ভেতরে নির্বাচনের প্রক্রিয়া অবশ্যই গণতান্ত্রিক হতে হবে। অযোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নেয়া যাবে না। এতে পার্টির ক্ষতি হয়, আন্দোলন ও জাতির ক্ষতি হয়। পার্টিতে এত যোগ্য নেতা থাকার পরও সন্তু বাবুর জামাই প্রণতি (ভিক্টর) বাবুকে সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়ার কোন মানে হয়?  অশোক বাবু অনেক বিচক্ষন ও দক্ষ নেতা, অথচ তাকে রাখা হয়েছে কোণঠাসা করে। পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা করুণ হওয়ার পেছনের কারণ হলো যোগ্য নেতাদের মর্যাদা না দেয়া। তারপর ইনুকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে আসার কোন অর্থ হয়? উষাতন তালুকদার এমপি হয়েছেন এটা খুব ভালো। কিন্তু  উনিও তো কাজ করতে পারছেন না। বা কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। সন্তু লারমার ঈর্ষাপরায়নতা এত বেশী যে, কেউ যদি তার কাছে উষাতন বাবুকে প্রশংসা করে কোন কথা বলে তাহলেও তার খারাপ লাগে। এবং খারাপ লাগাটা তিনি নানাভাবে প্রকাশ করেন।

কেউ তার উপরে উঠছে কিনা-সন্তু লারমার চোখ কেবল সেদিকে। তিনি কাউকে তার চাইতে বড়, দক্ষ যোগ্য হোক তা চান না। সে কারণে আজ পার্টিতে এ অবস্থা। সব যোগ্য নেতাগুলো এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, উষাতন বাবুরও ব্যক্তিত্ব থাকা দরকার, স্বাধীন সত্তা থাকা দরকার। সব সময় ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার বললে তো ‘স্যার’ আরো বেশী ‘‘ওগা’’পাবে। এমপি হয়েও ঠিকমত জনগণের পক্ষে কাজ করতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্ম তো দোষ দেবে উষাতন বাবুকে। তাই তার আরো জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার। সব সময় স্যারের কথায় উঠাবসা করা ঠিক হবে না। জাতীয় স্বার্থ ব্যক্তি ও পার্টির স্বার্থ থেকে অনেক অনেক বড়- এটা তার সব সময় মনে রাখতে হবে।

মঙ্গল কুমার চাকমা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এ সপ্তাহে তিনি ও উষাতন বাবু ব্রাসেলসে UNPO-তে যোগ দেবেন। এটা মনে রাখতে হবে, সরকারের সাথে চুক্তি হয়েছে পার্টির- সন্তু লারমা ব্যক্তিগতভাবে করেননি। তাই তিনি না থাকলেও চুক্তি শেষ হয়ে যাবে না। সরকারকে অবশ্যই এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।

সিএইচটি নিউজ ডটকম: যদি সন্তু বাবু আপনাদের দাবিমত এসব পদক্ষেপ না নেন, তাহলে আপনারা কি করবেন ভাবছেন?
বিক্ষুব্ধ সন্তু গ্রুপ নেতা: আমাদের যোগ্য নেতা আছেন, যাদের সাধারণ জুম্মদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে যা প্রয়োজন আমরা তাই করবো। আমরা সবার সাথে যোগাযোগ রাখবো-বৌদ্ধ ভিক্ষু, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আমাদের ‘‘বন্ধুরা’’। গত ১৮ বছরে ইউপিডিএফকে দমনের নামে পার্টি ও জুম্ম জনগণের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ইউপিডিএফ ধ্বংস না হয়ে বরং পার্টি দুই ভাগে ভাগ হয়েছে। অনেক শক্তি ক্ষয়, অপচয় হয়েছে। লোক ক্ষয় হয়েছে অনেক, যা আমাদের মতো ক্ষুদ্র একটি জাতির জন্য বিশাল ব্যাপার। অথচ এই শক্তি যদি আমরা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য নিয়োজিত করতে পারতাম তাহলে এতদিন চুক্তি বাস্তবায়ন হতো, জনগণ নিজেদের অধিকার ভোগ করতো। আর এটা হলে দেখুন জেএসএস-এর জনপ্রিয়তা কত উচুঁতে হতো। ইউপিডিএফ তখন এমনিই শেষ হয়ে যেতো। তাই আমাদেরকে অবশ্যই এই ১৮ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করে কারোর লাভ নেই-একমাত্র জুম্ম জনগণের শত্রুদের ছাড়া।

শেষে আর একটি কথা- আজ হোক কাল হোক আমাদেরকে অবশ্যই নতুন প্রজন্মের কাছে নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে হবে। আমরা চাই বা না চাই। কারণ এটাই জগতের নিয়ম। সন্তু লারমাকেও আজ হোক কাল হোক নেতৃত্ব একদিন ছেড়ে দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো তিনি কিভাবে নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে চান- মান সম্মানের সাথে ছেড়ে দিতে চান, নাকি অন্যভাবে? এই সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব একমাত্র তারই। সমাপ্ত।

সাক্ষাতকারের প্রথম অংশ পড়ুন:
* একান্ত সাক্ষাতকারে সন্তু গ্রুপ নেতা : সন্তু লারমা এখন আত্মীয় স্বজন ও চাটুকার পরিবেষ্টিত
——————

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More