মুক্তমত

এদেশের রাষ্ট্রনেতারা কী ম্রোদের প্লুং বাঁশির বেদনার সুর শুনবে?

0

রোনাল চাকমা

২০১৩ সালের ০৬ নভেম্বর “সাজেক ভ্যালিতে” পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম-২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি সাব্বির আহমেদ । ঘোষণার কিছু দিন পরেই ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ৩০ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে সাজেকে ভ্যালি দেখতে গিয়েছিলেন । জানা যায়, তিনি লুসাই আদিবাসী অধ্যুষিত রুইলুই পাড়ায় বেশ স্বাচ্ছন্যপূর্ণ ও সুন্দর সময় কাটিয়েছেন । সাজেকের সৌন্দর্য তখন থেকে পর্যটকদের কাছে ডানা মেলা শুরু করেছে । এবং তখন সাজেক প্রমোটে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে দেশের সব মিডিয়া , সেনাবাহিনী, বিভিন্ন ট্রাবেল গ্রুপ ও উন্নয়নের রাজনীতি করা নেতা-আমলারা । এই পর্যটন প্রমোট ও গড়ে তোলার ফাঁকফোকরে পড়ে কখন যে রুইলুই পাহাড়ে লুসাই ৮৫ পরিবার উচ্ছেদ হয়ে গেলো আমরা কেউ জানতে পারলাম না । কোনো মিডিয়া,সরকারি কর্মকর্তা ও আমলা এ বিষয়ে টু শব্দ করেননি, কেউ কিছু বলেননি।

গত মাসে (১৫ অক্টোবর ২০২০) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বান্দরবান সফরে গিয়েছিলেন । তিনি বান্দরবানে বেশ কিছু পর্যটন স্পট ঘুরে দেখেন । অথচ এর মধ্যে স্থানীয় ভূমিপুত্র ম্রোদের ৮০০ একরের উপর বেশি জায়গা দখল করেছে সেনা কল্যান সংস্থা ও সিকদার গ্রুপ । তাঁরা চিম্বুক পাহাড়ের ৭০ থেকে ৮০টি ম্রো পাড়ার ১০,০০০ ম্রো উচ্ছেদের হুমকির মুখে নির্মাণ করছে ৩৫০ কোটি টাকার বাজেটে বিলাসবহুল হোটেল ম্যারিয়ট ও পর্যটন স্থাপনা।

এর আগেও হোটেল-রিসোর্ট, পর্যটন স্থাপনা ও সেনা-বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণে পাহাড়ে যেসব জমি জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে তাঁর একটি ছোট্ট চিত্র দেখুন-

১.কাপ্রু ম্রো পাড়া (নীলগিরি) । জমির পরিমাণ- ৬০ একর। উচ্ছেদ-২০০ ম্রো ও মারমা পরিবার ।

২.চিম্বুক পাহাড় (সুয়ালক,ভাগ্যকুল ,টংকাবতী,কদুখোলা ।জমির পরিমাণ- ১১,৪৬৮.৪৮ একর । উচ্ছেদ–৭৫০ পরিবার।

৩.রুইলুই পাড়া (সাজেক)। জমির পরিমাণ- ৫ একর। উচ্ছেদ-৬৫ পরিবার।

৪.নীলাচল (বান্দরবান)। জমির পরিমাণ– ২০ একর। উচ্ছেদ- ১০০ পরিবার।

৫. ক্রাউডং/রংরাং পাহাড় (ডিম পাহাড় )। জমির পরিমাণ-৫০০ একর (প্রক্রিয়াধীন)। উচ্ছেদ- ২০২ পরিবার।

৬.সেপ্রু পাড়া (জীবননগর )। জমির পরিমাণ- ৫০০ একর(প্রক্রিয়াধীন)।

৭.চন্দ্রপাহাড়(বান্দরবান) । জমির পরিমাণ- ৫০০ একর (প্রক্রিয়াধীন)। উচ্ছেদ- ১২৯ পরিবার ।

৮.যত্ন মোহন কার্বারি পাড়া (বাবুছড়া,দিঘীনালা)। জমির পরিমাণ-২৯.৮১ একর । উচ্ছেদ- ২১ পরিবার।
[সূত্রঃ ‘‘আলুটিলা ভূমি রক্ষা ছাত্র জোটের’’ প্রকাশিত লিফলেট]

দেশের রাষ্ট্রপ্রধান-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যেকটা সফর যদি পাহাড়িদের উচ্ছেদ, ভূমি হারানো ও দুর্দশা-দুর্গতির কারণ হয় তাহলে এদেশ পাকিস্তান থেকে কোনো অংশে কম? এদেশের বর্তমান রাষ্ট্রনেতারা কী কুখ্যাত আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের চেয়েও স্বৈরাচারী ও দখলবাজ নয়?

পরাধীন থাকার সময় এদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কারণ ছিলো পাঞ্জাবিরা-পাঠান শাসকরা। আজ স্বাধীন দেশে পাহাড়িদের দুঃখ-দুর্দশরা কারণ কী তাহলে নব্য পাকিস্তানি বাঙালি শাসকরা?!

আজো কাপ্তাই বাঁধের বিদ্যুতের তারে যেমন পাহাড়িদের দীর্ঘশ্বাস বয়ে চলে, ঠিক স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও রাষ্ট্রীয় নেতাদের পাহাড় সফরে পাহাড়িদের ভূমি হারানোর হাহাকার-বেদনা-ক্ষোভ বয়ে চলে।

৮ নভেম্বর ২০২০ চিম্বুক পাহাড়ের সন্তান শত শত ম্রো নিজেদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র প্লুং নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন নিজেদের মা-মাটি-পাহাড় রক্ষার্থে। শত শত ম্রো নারী সন্তানদের কোলে নিয়ে এসেছিলেন প্রতিবাদ জানাতে। যেন তাঁদের সন্তান এই পাহাড়ের গায়ে প্লুং বাশিঁর সুরে সুরে নিরাপদে হেসে খেলে বেড়ে উঠতে পারে।

ম্রোদের লোককথা প্রচলিত আছে, “একবার এক ম্রো গ্রামে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন একজনকে স্বপ্নে দেখানো হয় যে ৭টি ছিদ্রওয়ালা এক বাঁশি বাজিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করলে কলেরা চলে যাবে। পরে সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তৈরি করা হয় এই প্লুং বাঁশি।’’

প্রকৃতির সহজ-সরল সন্তান ম্রো’রা পাহাড় রক্ষার্থে সেই প্লুং বাশিঁ নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদে সামিল হয়েছে, তাঁরা হোটেল-পর্যটন স্থাপনা বন্ধে পাঁচ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে।

এদেশের রাষ্ট্রনেতারা কী ম্রোদের প্লুং বাশিঁর বেদনার সুর শুনবে?

* লেখক: রোনাল চাকমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্র।

 

[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখকের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত/প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More