ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস আজ

0
ছবি: কালের কণ্ঠ

আজ ৩০ জুন। ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে দিবসটি এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। বলা হয়, এটিই প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম।

সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সেদিনের দেশপ্রেমিক সংগ্রাম, আদর্শ ও অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ, পরে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত করেছিল; জুগিয়েছিল সাহস ও উদ্দীপনা। দিবসটিতে এ বছর ১৬৬ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ১৮৫৫ সালের এই দিনে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল সাঁওতালরা। তাতে ইংরেজ সৈন্য ও প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা মারা যায়।

সাঁওতাল বিদ্রোহ সেদিন ব্রিটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে সিদু-কানহু-চাঁদ ও ভাইরব পর্যায়ক্রমে নিহত হলে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় এবং ওই বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে ১৬৫ বছর আগে  ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের চার ভাই সিদু-কানহু-চান্দ ও ভাইরবের নেতৃত্বে আদিবাসীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ওই  যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।

দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ। বহু কষ্ট করে জঙ্গল কেটে, বন পরিষ্কার করে তারা নিজেদের জনপদ গড়ে তুলেছিল। অতীতে যে মাটিতে কোনো মানুষের পা পড়েনি, সেই মাটিকে তারা বাসযোগ্য করে গড়ে তুলেছিল, মাটিতে ফলিয়েছিল ধান, ভুট্টা, নানা ধরনের সবজি আর সোনালি ফসল। সুখেই ছিল তারা দামিন-ই কোহতে।

নিজেদের জন্য একটি পৃথক জগৎ তৈরি করেছিল নৃগোষ্ঠীরা। সেই জগতে কোনো মহাজন, দালাল, জমিদার ছিল না।  কিন্তু ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণি দলে দলে আসতে শুরু করে সাঁওতাল পরগনায়। তারা সাঁওতাল পরগনায় ঢুকে বিপুল পরিমাণ ধান, সরিষা ও অন্যান্য তৈলবীজ গরুর  গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে যেত। বিনিময়ে সাঁওতালদের দেওয়া হতো সামান্য লবণ, টাকাপয়সা, তামাক অথবা কাপড়।

এসব বিনিময়ের সময় চরমভাবে ঠকানো হতো সাঁওতালদের। কিছু অর্থ, কিছু চাল বা অন্য কোনো দ্রব্য ঋণ দিয়ে সমস্ত জীবনের জন্য সাঁওতালদের ভাগ্য বিধাতা হয়ে বসত মহাজনরা। ফসল কাটার মৌসুম এলে মহাজন শ্রেণি গরু গাড়ি ও ঘোড়া নিয়ে সাঁওতাল পরগনায় আসত। বার্ষিক আদায়ে আসার সময় একটি পাথরে সিঁদুর মাখিয়ে নিয়ে আসত, সাঁওতালদের বলত যে, এ পাথরের ওজন নির্ভুল। ওই পাথরের সাহায্যে ওজন করে মহাজনরা সাঁওতালদের সমস্ত ফসল তুলে নিয়ে যেত। তার পরও আদিবাসীদের ঋণের বোঝা কমত না।

মহাজনরা একজন সাঁওতালকে ঋণের জন্য তার জমির ফসল, চাষের গরু এমনকি নিজেকেও বলি দিতে হতো তার পরিবারের কাছ থেকে। আর সেই ঋণের দশগুণ পরিশোধ করলেও কমতো না কখনও।

মহাজন, দালাল, জমিদার কর্তৃক নিরীহ ও সরল আদিবাসীদের শোষণ ও নির্যাতনে পরো মদদ দিত ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনী। এ কারণে আদিবাসীরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তা শেষ হয়।

সাঁওতালরা তীর-ধনুক ও দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলেও ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিল বন্দুক ও কামান। এ যুদ্ধে অনেক ইংরেজ সৈন্য মারা যায়। আর মারা যান প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভগনাডিহি গ্রামে বীর সিধু-কানুর নেতৃত্বে এ বিদ্রোহ হয়েছিল। সাঁওতালি জাতি তার নিজ ভূমিতে স্বাধীন সাঁওতালি রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিতে সেদিন গর্জে উঠেছিল। ইংরেজ নীলকুঠিতে ও জমিদারদের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

বিদ্রোহ দমনের নামে বহু গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হাজার হাজার সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করে জেলে দেওয়া হয়। বিদ্রোহের মহান নেতা সিধু-কানুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে এ বিদ্রোহে অংশ নেওয়া হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দেয়। যুদ্ধে সিধু-কানহু-চান্দ ও ভাইরব পর্যায়ক্রমে নিহত হলে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় ও এ বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে। সেদিনের সাঁওতাল বিদ্রোহের রক্তাক্ত পথ ধরে মুণ্ডা বিদ্রোহ, তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ, টংক আন্দোলন, তেভাগা ও পরবর্তীকালের ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলনসহ আরও অনেক আন্দোলন হয়েছে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More