খাগড়াছড়িতে উগ্রসাম্প্রদায়িক হামলার ৫ম বার্ষিকীতে আলোচনা সভা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন

0

সিএইচটিনিউজ.কম

মহাজন পাড়া
মহাজন পাড়া

খাগড়াছড়ি: “অস্তিত্ব ও আত্মরক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ হোন, ভ্রাতৃপ্রতিম সংহতি সুদৃঢ় করুন” এই শ্লোগানে খাগড়াছড়িতে উগ্রসাম্প্রদায়িক হামলার ৫ম বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালন করেছে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন। সোমবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) খাগড়াছড়ি শহরের মহাজন পাড়া ও মধুপুর এলাকায় একই সময়ে পৃথক পৃথকভাবে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।

খাগড়াছড়ি শহরের মহাজন পাড়ায় সূর্যশিখা ক্লাবের মাঠে বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার আহ্বায়ক জিকো ত্রিপুরার সভাপতিত্বে এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রতন স্মৃতি চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমনি চাকমা, ভাইস চেয়ারম্যান রণিক ত্রিপুরা, বিশিষ্ট মুরুব্বী ও মা’জন পাড়া সমাজ উন্নয়ন কমিটির সভাপতি রবি শংকর তালুকদার, বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা যুবতারা চাকমা, জামতলী সমাজ উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনুপম চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি মিশুক চাকমা। এছাড়া অ্যাডভোকেট সমারি চাকমাও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

অপরদিকে, মধুপুর এলাকায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার অর্থ সম্পাদক সুনীল ত্রিপুরার সভাপতিত্বে এবং সদস্য এল্টন চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মধুপুর গ্রামের কার্বারী বিমল চাকমা, ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক দীপায়ন চাকমা, ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা সংগঠক চরণসিং তঞ্চঙ্গ্যা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অংগ্য মারমা।

মধুপুর
মধুপুর

আলোচনা সভা শুরুর আগে সাজেকসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াই সংগ্রামে সকল শহীদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

আলোচনা সভা শেষে সন্ধ্যা ৬টায় মহাজন পাড়ার সূর্যশিখা ক্লাবের সামনে সড়কে ও মধুপুর-পানখাইয়া পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় সড়কে দাঁড়িয়ে একযোগে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।

মহাজন পাড়া এলাকায় অনুষ্ঠিত প্রদীপ প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সদস্য বরুণ চাকমা ও পিসিপির জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রতন স্মৃতি চাকমা।

অপরদিকে, মধুুপুর এলাকায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জুপিটার চাকমা, জেলা শাখার নেতা জেসীম চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অংগ্য মারমা ও জেলা শাখার নেতা লালন চাকমা। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের জেলা শাখার সহ-সভাপতি অর্না চাকমা এতে সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য শেষে ১৯৯৬ সালে ৩১ মার্চ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদ ক্যজাই মারমার স্মরণে মধুপুর পানখাইয়া পাড়া স্কুল মোড়ে একত্রিতভাবে সকল প্রদীপ প্রজ্জ্বালন করা হয়।

মহাজন পাড়া
মহাজন পাড়া

অনুষ্ঠানে বক্তারা ২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরে পাহাড়িদের উপর উগ্রসাম্প্রদায়িক হামলা স্মরণ করে বলেন, স্থানীয় সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের মদদেই বাঙালি সেটলারদের লেলিয়ে দিয়ে সেদিন এই ভয়াবহ হামলা চালানো হয়েছিল। এ হামলা বিষয়ে প্রশাসন আগে থেকেই অবগত ছিল। যার কারণে সেদিন পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও হামলাকারীদের বাধা না দিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। এ হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়িদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা এবং তাদের অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়া।

বক্তারা আরো বলেন, পাহাড়িদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগ,বিএনপি, জাতীয় পার্টি করছে তারা নিজের জাতির অস্তিস্তকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প কোন পথ নেই।

তারা বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে ধ্বংস করার জন্য সর্বদা তৎপর রয়েছে। অথচ আমাদের অনেকে সরকার দলীয় সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা বেশী দিন টিকতে পারবো না। সরকার একদিকে চুক্তি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিচ্ছে, অন্যদিকে জাতিসত্তা ধ্বংসের জন্য নীলনক্সা বাস্তবায়ন করছে। তাই যতদিন অধিকার অর্জন না হয় অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে বলে বক্তারা মত প্রকাশ করেন।

বক্তারা বলেন, সাজেকের জনগণ লড়াই করেছে বলে আজ সাজেককে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। নিজেদের অস্তিত্ব ও আত্মরক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য বক্তারা সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

ক্ষমতাসীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা অগণতান্ত্রিক উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, দেশের মানবাধিকার সংগঠনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সরকার একদিকে জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর ঘোষণা দিচ্ছে, অন্যদিকে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংখ্যলঘু জাতিসমূহকে বাঙালি বানিয়েছে। সরকারের এই বৈষম্যমূলক নীতির  বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

মধুপুর
মধুপুর

বক্তারা আরো বলেন, আজ ৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও এই বর্বরোচিত হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু সে সময় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে নিরীহ পাহাড়িদের আটক ও হয়রানি করেছিল। হামলাকারী ও উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে ধারাবাহিকভাবে রামগড়ের শনখোলা পাড়া-জালিয়াপাড়া-মানিকছড়ি, মাটিরাংগার তাইন্দংসহ বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের হামলার ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে।

বক্তারা খাগড়াছড়ি সাম্প্রদায়িক হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও উস্কানিদাতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া না হলে ভবিষ্যতে এরা আবারো এ ধরনের হামলা ঘটাতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন। এজন্য বক্তারা এ হামলার উস্কানিদাতা ও হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি সেটলাররা খাগড়াছড়ি শহরের মহাজন পাড়া, কলেজ পাড়া, মধুপুর, মিলনপুর ও সাতভেইয়া পাড়ায় পাহাড়ি বসতি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। এতে পাহাড়িদের ৬০টির অধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
——————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More