খাগড়াছড়িতে কারামুক্ত রেহেনা চাকমা ও জেসীকা ত্রিপুরাকে সংবর্ধনা দিয়েছে পিসিপি
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়িতে কারামক্ত বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) মাটিরাঙ্গা উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রেহেনা চাকমা ও গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী ছাত্রী জেসীকা ত্রিপুরাকে সংবর্ধনা দিয়েছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখা।
নয়না ত্রিপুরা নামে এক নারীকে কথিত অপহরণের অভিযোগে গত ১০ অক্টোবর ২০১৭ সেনাবাহিনী ও পুলিশ রেহানা চাকমা ও জেসীকা ত্রিপুরাকে আটক করে। ২৫ দিন কারাভোগের পর গতকাল সোমবার (৬ নভেম্বর ২০১৭) আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করলে তারা কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন।
মুক্তি পাওয়ার পর দুপুর ১২টায় খাগড়াছড়ি জেলা শহর স্বনির্ভর বাজার ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটি ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) কার্যলয়ে পিসিপি নেতা-কর্মীরা তাদের সংবর্ধনার আয়োজন করে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটি ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটে সংগঠক মাইকেল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা, পিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রেশমি মারমা। এতে কারামুক্ত পিসিপি নেতা রেহেনা চাকমাও বক্তব্য রাখেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জাতিসত্তার অধিকার ও সম্মান মর্যাদা রক্ষায় ভুমিকা রাখার কারণে রেহানা ও জেসিকাসহ শতশত আন্দোলনকামীকে আজ কারাবরণ ও নিপীড়ন নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে। কিন্তু কোনো ধরণের গ্রেপ্তার নির্যাতন ও রাতে বিরাতে তল্লাশি আটক মিথ্যা মামলা প্রদান করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন দমানো যাবে না। সকল ধরণের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে অধিকারের সংগ্রাম এগিয়ে চলবে। অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।
বক্তারা আরো বলেন, আমরা তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণ আজ গর্বিত হচ্ছি, কেননা আমাদের নারীরা এখন ঘরের ভিতরে সীমাবদ্ধ নেই। তারা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে শিখেছে। ব্রিটিশ আমলে নারীদের আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করতে হয়েছে, অনেকে আত্মহুতি দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে এদেশের নারীদের জেল জুলুমের শিকার হতে কম দেখা গেছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসের রেহেনা চাকমা, জেসীকা ত্রিপুরাসহ আরো বহু জুম্ম নারী নিজেদের অধিকারে জন্য লড়াই করতে গিয়ে কারাবরণের শিকার হয়েছে এবং শিকার হতে হচ্ছে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কারামুক্ত রেহেনা চাকমা আটক হবার বিবরণ তুলে ধরে বলেন, গত ১০ অক্টোবর রাত পৌনে ১টায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ মাটিরাঙ্গার বাইল্যাছড়ি হানা দিয়ে তাদের বাড়ি ঘেরাও করে। কোনো গ্রেপ্তারী পরোয়ানা না থাকার পরেও গুইমারা থানার ওসি শাহাদাৎ হোসেন টিটু গভীররাতে রুমে প্রবেশ করে তাকে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে তুলে বাড়ির বাহিরে নিতে চায়। এই সময় কোনো মহিলা পুলিশ ছিলো না বিধায় তিনি বাহিরে যেতে না চাইলে তাকে জোর করে বিছানা থেকে তুলে নেয়া হয়। এমনকি কাপড়-চোপড় পড়তে পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এক কথায় তাকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর তিনি বলেন, থানায় নিয়ে গিয়ে প্রশাসন ও তাদের গোয়েন্দারা নয়না অপহরণের ঘটনা বিষয়ে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করে। নানান ভয় ভীত ও প্রলোভন দেখিয়ে ঘটনায় যুক্ত থাকার মিথ্যা স্বীকৃতি আদায় করার চেষ্টা করে। ঘটনাটি অস্বীকার করলে মামলা-হামলা, নির্যাতন ও বৈদ্যুতিক শক দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। তারপরও তারা অস্বীকার করলে তাদেরকে অবৈধভাবে ২ দিন থানায় রেখে খাগড়াছড়ি আদালতে পাঠানো হয়। আদালত সেখান থেকে তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করে।
তিনি ওসি শাহাদাৎ-কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সে দিনে আমাদেরকে আটক করে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন তার জন্য আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই। কেননা সে দিনে প্রশাসনের নানান হুমকি ধামকি ও কারাবরণ সহ্য করে আমাদের ভবিষ্যতে আন্দোলন সংগ্রাম করতে আরো সুদৃঢ়, উৎসাহ, সাহস, মনোবল বেড়েছে। তিনি সে ঘটনার ফলে নিজেকে দেশ-জাতি-সমাজ পরিবর্তনে আরো একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বলে গর্ব করেন।
বক্তারা সরকারকে সমালোচনা করে বলেন, এই সরকার রেসিস্ট ও ফ্যাসিস্ট। তা না হলে তারা সে ঘটনাগুলো ঘটাতো না, নিরীহ মানুষকে হয়রানি করতো না, জেলে পাঠাতো না। যে মেয়ে সামাজিক রীতি নীতি উপেক্ষা করে সামাজিক আইন লঙ্ঘন করে অসামাজিক ও সামাজিক বহির্ভূত কাজ করেছে সে মেয়েকে সমাজের মানুষরা সমাজের আত্মমর্যাদা ফিরানোর জন্য গাড়ী থেকে নামিয়ে রেখেছে। তার জন্য প্রশাসন সমাজের মানুষদের সহযোগিতা দেওয়া দরকার। কিন্তু বিপরীতে সাধারণ পাহাড়িদেরকে আটক নির্যাতন করছে তা খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।
তারা আরো বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমান পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিত সেনা শাসন চলছে। অপারেশন উত্তোরণ, অপারেশন দাবানলের নামে নিরীহ জনগণের উপর শাসন শোষণ চালাচ্ছে, নির্যাতন চালাচ্ছে, ও ধরপাকড়, আটক, বাড়ি ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে। এমনকি সেনা শাসনের ফলে এখানকার প্রশাসনকে নিরুপায় হয়ে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু সরকার তা কোন দিনও স্বীকার করেনি যে পার্বত্য অঞ্চলে সিভিল প্রশাসন নয়, সেনা শাসন চলছে।
তারা এখানকার প্রশাসনকে হুশিয়ার করে বলেন, দমন-পীড়ন, নির্যাতন, করাবরণ করিয়ে একটি জাতির আন্দোলনকে স্তব্দ করা যায় না। যতই দমন পীড়ন করবে ছাত্র-যুব-নারী সমাজসহ সর্বস্তরে জনগণ সংগঠিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবে। এই সরকারকে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার মন্তব্য করে বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার আগে এই দেশের জনগণের উপর পাক বাহিনীরা যেভাবে শাসন শোষণ নির্যাতন চালিয়েছিল, হত্যা করেছিল তাদের বিরুদ্ধে এই দেশের প্রতিরোধ করেছে এবং দেশ স্বাধীন করেছে। বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে যেভাবে দমন-পীড়ন, নির্যাতন করছে তার পরিণাম শুভ হবে না। এই অন্যায় দমন-পীড়ন বন্ধ না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করবে বলে বক্তারা হুঁশিয়াররি দেন।
বক্তারা, রেহেনা, জেসীকাসহ যারা সাহসীকতার সাথে বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশ-জাতি ও সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত থেকে জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সে সকল মুক্তিকামী জনতাকে রেড স্যালুট জানান।
—————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।