খাগড়াছড়িতে তিন দিনব্যাপী পিসিপি’র ১৯তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল উদ্বোধন :পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রদানপূর্বক জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটিনিউজ.কম
“সমাজ ও জাতীয় আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টিকারী সরকারি এজেন্টদের প্রতিহত করুন! আসুন, অধিকার আদায়ের আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের গৌরবোজ্জ্বল পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরি” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ১১-১৩ জানুয়ারি তিন দিনব্যাপী বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর ১৯তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল আজ ১১ জানুয়ারি বুধবার উদ্বোধন করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১১টায় খাগড়াছড়ি জেলা সদেরর স্বনির্ভর মাঠে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম এম.ই.এস কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় কমিটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মো: হোসেন খান। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মারমার সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কণিকা দেওয়ান ও খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নিরাপদ তালুকদার। এছাড়া সংহতি জানিয়ে আরো বক্তব্য রাখেন বংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক সামিউল আলম, বিপ্লবী ছাত্র সংঘের আহ্বায়ক আশীষ শর্মা, ল্যাম্প পোষ্টের প্রিন্স মাহমুদ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সালমান রহমান, সংস্কৃতি নয়া সেতুর দপ্তর সম্পাদক নিত্যানন্দ পাল, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক থুইক্যচিং মারমা ও উপস্থাপনা করেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুমেন চাকমা। সম্মেলনে তিন পার্বত্য জেলা থেকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দুই সহস্রাধিক নেতা-কর্মী অংশ নেয়।
অনুষ্ঠান শুরুতে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে শোক প্রস্তাব পাঠ ও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ক্যহলাচিং মারমা। এছাড়া অনুষ্ঠানে আগত অতিথিবৃন্দকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করা হয় এবং সদ্য কারামুক্তদেরও ফুল দিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
কাউন্সিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান এবং পাহাড়িজাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব রক্ষায় জীবনবাজি রেখে লড়ে যেতে আহবান জানিয়েবলেন, রাষ্ট-সরকার এবং ধনিকশ্রেণীর রাজনীতি পার্বত্য চট্টগ্রামের দরিদ্রপাহাড়ীদের বিরুদ্ধে পূর্ণবাসিত বাঙ্গালীদের লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এইঅবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিবাদী ছাত্র-যুবসমাজের ওপর রাষ্ট্রীয়জুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
বক্তারা বলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার চরম ফ্যাসিবাদী আচরণ শুরু করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সারাদেশের জনগণের উপর সরকার শোষণ-নির্যাতন জারি রেখেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়ে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসমূহের ধ্বংসের চক্রান্ত চালাচ্ছে।
বক্তারা আরো বলেন, সারাদেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ক্রমেই মারাত্মক আকার নিচ্ছে। র্যাবেরতথাকথিত ক্রস ফায়ারে মানুষ হত্যার নব্য সংস্করণ গুপ্ত হত্যা শুরু হয়েছে। সরকার প্রতি পদে পদে আজ জনগণের নিরাপত্তা দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে দ্রব্য মূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি। জনগণের জীবন-জীবিকার ন্যূনতম কোন দাবি দাওয়া পর্যন্ত সরকার বিবেচনা করছে না। মহাজোট সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একের পর এক দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তারা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো।
বক্তারা বলেন, সরকার শুধু নিপীড়ন-নির্যাতন করে ক্ষান্ত নয়। ছাত্র-যুব সমাজকে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে মদ, গাঁজা, হিরোইন ইত্যাদি মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই নিপীড়ক শাসক গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা ছাড়া পাহাড় ও সমতলে কোনভাবে কৃষক, শ্রমিক ও নিপীড়িত জনগণের মুক্তি আসতে পারে না। তাই সকল ধরনের নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাহাড় ও সমতলের নিপীড়িত জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বক্তারা সকল ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা স্থাপনা নির্মাণের নামে এবং সেটলারদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী ও ভূমি দস্যুদের কর্তৃক ভূমি বেদখলের পাঁয়তারা চলছে।
বক্তারা বলেন, সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মুলা ঝুলিয়ে একদিকে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে, অন্যদিকে আন্দোলন ধ্বংসের চক্রান্তের অংশ হিসেবে সন্তু লারমাকে দিয়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে।
বক্তারা অবিলম্বে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রদানপূর্বক জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সেনা শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ‘ তুলে নেয়া, খাগড়াছড়ি ও রুমায় বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণ বন্ধ করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার,রাঙ্গামাটির সাজেক, রামগড় শনখোলা পাড়ায় সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের নিরপে গণতদন্ত কমিটি গঠন, খাগড়াছড়ি সহ সারাদেশে সভা সমাবেশের উপর বিধি নিষেধ তুলে নেয়া ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা, পাহাড়ি উচ্ছেদের লক্ষ্যে সেটলার পুনর্বাসন ও সেনা ক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে ভূমি অধিগ্রহণ ও সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ করা, অস্থিতিশীল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গমা বাঁধানোর ল্েয সেটলার বাঙ্গালিদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা, ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে হত্যা ও গুম বন্ধ করা, শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দফা দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে স্বনির্ভর মাঠ থেকে একটি র্যালী বের হয়ে চেঙ্গী স্কোয়ার ঘুরে শান্তি নিকেতন, উপালি পাড়া ও নারানহিয়া হয়ে আবার স্বনিভর মাঠে গিয়ে শেষ হয়। র্যালী শেষে একটি সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
খাগড়াছড়ি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউ হলরুমে আগামী ১২ -১৩ জানুয়ারী দুই দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। কাউন্সিল অধিবেশন শেষে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হবে।