খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি নারী সম্মেলন: ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ’ নামে নতুন একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ

0

খাগড়াছড়ি : ‘নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন, অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত হোন’ এই শ্লোগানে পার্বত্য চট্টগামের পাহাড়ি নারীদের নিয়ে আজ ৩ মে শুক্রবার খাগড়াছড়িতে দিনব্যাপী এক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। খাগড়াছড়ি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের অডিটোরিয়োমে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলা থেকে নারী জনপ্রতিনিধি সহ চার শতাধিক নারী অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলন শেষে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ’ নামে একটি নতুন নারী সংগঠন গঠন করা হয়েছে।

দুই পর্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে প্রথম অধিবেশন শুরু হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। সম্মেলন শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সকল শহীদ ও সাভারে সদস্য ঘটে যাওয়া রানা পস্নাজা ভবন ধসে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব পাঠ করা হয়। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য মিন্টি চাকমা।
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি সোনালী চাকমার সভাপতিত্বে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কণিকা দেওয়ান, সাজেক নারী সমাজের সভাপতি নিরূপা চাকমা, ঘিলাছড়ি নারী সমাজের সভাপতি শান্তি প্রভা চাকমা। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত নারী জনপ্রতিনিধি ও মুরুব্বীদের মধ্যে থেকে বক্তব্য রাখেন খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি ইউপি সদস্য মল্লিকা চাকমা, উত্তর খবংপয্যা সমাজ উন্নয়ন কমিটির সদস্য সুমিতা চাকমা, ভাইবোন ছড়া ইউপি সদস্য করুণাময়ী চাকমা, পানছড়ির লতিবান ইউপি সদস্য মনিকা চাকমা, রাঙামাটি জেলার নান্যাচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউপি সদস্য রমিতা চাকমা, বন্দুকভাঙা ইউপি সদস্য অলকা চাকমা ও কল্পনা চাকমা এবং কাউখালী ইউপি সদস্য পাইক্রমা মারমা প্রমুখ। এছাড়া ইউপিডিএফ’র খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সমন্বয়ক প্রদীপন খীসাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন পরিচালনা করেন সুমনা চাকমা এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন দীপনা চাকমা।
সম্মেলনে ইউপিডিএফ’র সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা এমনভাবে বেড়ে গেছে, নারীদের বসে থাকার আর কোন সুযোগ নেই। পুরম্নষেদের পাশাপাশি নারীদেরও সংগঠিত হয়ে অন্যায়-অবিচার ও নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীদের আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, পূর্ণস্বায়ত্তশাসন অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই নিরাপদ নয় এবং পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারবো না।
তিনি আরো বলেন, এদেশের কোন সরকারই গণতান্ত্রিক নয়। যে দল সরকার গঠন করে সেই দল ছাড়া অন্যান্য দল বা সংগঠন ঠিকমত সভা-সমাবেশ করতে পারে না। আমরাও অনেক কিছু করতে পারছি না। তারপরও আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। সবাইকে নিজেরে অবস্থান থেকে এগিয়ে এসে সমাজ ও জাতির জন্য কাজ করতে হবে।
সম্মেলনে অন্যান্য বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পার্বত্য জেলাগুলিতে নারী নির্যাতন বিরোধী সংগঠন গঠনের মাধ্যমে নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, খুন, অপহরণ সহ সকল ধরনের নিপীড়ন নির্যাতন বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নতুন সংগঠন গঠনের উপর জোর দেন।
এরপর বেলা ২:৩০টায় শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। সুমনা চাকমার উপস্থাপনায় ও সোনালী চাকমার সভাপতিত্বে এ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন, ইউনাইটেড পিপল্‌স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর খাগড়াছড়ি জেলা সমন্বয়ক প্রদীপন খীসা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি নিরূপা চাকমা, পানছড়ি উপজেলার ইউপি সদস্য অপরাজিতা খীসা, রামগড় উপজেলার ইউপি সদস্য উক্রাসং মারমা, অমিতা রোয়াজা এবং বুড়িঘাট ইউপি সদসস্য কাজলী ত্রিপুরা প্রমুখ।
সম্মেলনে উপস্থিত সকলের সর্বসম্মতিক্রমে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ’ নামে একটি নতুন নারী সংগঠন গঠন করা হয়। নতুন এ সংগঠনে সোনালী চাকমাকে সভাপতি, অমরাজিতা চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও নয়নতারা চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৪১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। উপস্থিত সকলে তুমুল করতালির মধ্যে দিয়ে এ কমিটিকে পাশ করেন।
সম্মেলনে নিম্নোক্ত ৬ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়:
১। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতন এবং বিশেষত পাহাড়ী নারীদের উপর যৌন আক্রমণ বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। গত বছর (২০১২ সাল) ১৯ জন পাহাড়ী নারী ধর্ষিত, ১২ জন ধর্ষণ প্রচেষ্টা, ১ জন যৌন হয়রানি ও অন্য ১ জন অপহরণের শিকার হন। এ বছর জানুয়ারী থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫ জন পাহাড়ী নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আমরা নারী নির্যাতন বন্ধ ও পাহাড়ী নারীদের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ পর্যন্ত্ম ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যাসহ যেসব নারী নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার প্রত্যেকটির বিচার ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।
২। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ” প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করছি। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী সমাজকে এই সংগঠনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
৩। আমরা গত এপ্রিলে মাটিরাঙ্গায় একটি পাহাড়ী গ্রামে হামলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং অবিলম্বে এধরনের ঘটনা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি।
৪। আমরা মনে করি, পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন, প্রথাগত ভূমি অধিকার, সেনা ও সেটলার প্রত্যাহারের সাথে নারী অধিকারের প্রশ্নটি জড়িত রয়েছে। পূর্ণস্বায়ত্তশাসন ছাড়া আলাদাভাবে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রদান, প্রথাগত ভূমি আইনের স্বীকৃতি ও সেনা-সেটলার প্রত্যাহারের দাবী জানাচ্ছি।
৫। আমরা সন্তু লারমার ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত জিইয়ে রাখার নীতির তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে ভাইয়ের বুকে গুলি চালানো বন্ধ করে সরকারের বিরম্নদ্ধে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে ইউপিডিএফের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
৬। আমরা সাভারে রানা পস্নাজার ভবনধসে নিহতদের স্মরণে শোক প্রকাশ করছি এবং আহত ও নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। একইসাথে আমরা রানা পস্নাজার মালিকসহ জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী জানাচ্ছি।
এছাড়া সংগঠন পরিচালনার সুবিধার্থে কিছু নীতিমালাও সম্মেলনে গৃহীত হয়।
সম্মেলন শেষে বিকাল ৫ টায় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণ হতে একটি র‌্যালি বের করা হয়। র‌্যালিটি চেঙ্গী স্কোয়ার হয়ে মহাজন পাড়ার সূর্যশিখা ক্লাবের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের পর আবার একই স্থানে এসে শেষ হয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তি।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More