খাগড়াছড়িতে পিসিপি’র আলোচনা সভা : ৩০ অক্টোবরের চেতনায় জ্বলে উঠার আহ্বান
খাগড়াছড়ি : ১৯৯৩ সালের ৩০ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার গৌরবোজ্জ্বল প্রতিরোধ ও নারাঙহিয়া চৌমুহনীকে ‘রেড স্কোয়ার’ ঘোষণার ২৪ বছরপূর্তি উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে আলোচনা সভা করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখা।
‘৩০ অক্টোবরের চেতনায় জ্বলে উঠুন; নিয়োগ-গ্রেফতার-প্রমোশন বাণিজ্য প্রতিরোধের ঐক্যবদ্ধ হোন’ এই শ্লোগানে আজ সোমবার (৩০ অক্টোবর ২০১৭) সকাল ১১টায় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভরস্থ ঠিকাদার কল্যাণ সমিতি ভবনের হলরুমে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পিসিপি’র খাগড়াছড়ি জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা। এতে আরো বক্তব্য রাখেন ‘৯৩-এর ৩০ অক্টোবর প্রতিরোধ সংগ্রামের অন্যতম সাহসী ছাত্র নেতা ও তৎকালীন পিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বর্তমানে ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা ও ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক মাইকেল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা, পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি বিপুল চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক রেশমি মারমা প্রমুখ।
সভা পরিচালনা করেন পিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা।
সভায় বক্তারা বলেন, ৩০ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবাজ্জ্বল দিন। রাষ্ট্রীয় অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার বিজয়ের দিন। অন্যায় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে অসীম সাহসে রুখে দাঁড়ানোর দিন। আজ থেকে ২৪ বছর আগে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে যে গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল সে সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব বর্তমান ছাত্র ও তরুণ প্রজম্মের কাঁধে এসে বর্তিয়েছে। সেদিন ছাত্র জনতার বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের মুখে প্রশাসন আটককৃতদের সরকারি ছুটির দিনে (শুক্রবার) বিশেষ কোর্ট বসিয়ে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
বক্তারা জেলা পরিষদ কর্তৃক সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে একেকজন প্রার্থীর কাছ থেকে ১০ থেকে ১৩ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। বক্তারা বলেন, শাসক দলের অনুগত পান্ডাদেরকে পরিষদের শীর্ষ পদে নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসসহ গোটা পরিষদকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। তারা বলেন, পিসিপি শুরু থেকে জেলা পরিষদকে দালাল পরিষদ আখ্যায়িত করে আসছে। সমীরণ-গৌতম-জেরি থেকে শুরু করে তাঁদের উত্তরসূরিরা শাসকগোষ্ঠীর দালালী ও লেজুড়বৃত্তির যোগ্যতায় পরিষদের গদিতে আসীন হয়েছে। এসব দালাল ও শাসকগোষ্ঠীর পদলেহীদেরকে সামাাজিকভাবে বয়কটের আহ্বান জানান বক্তারা।
বক্তারা আরো বলেন, দুর্নীতিবাজ ও অসৎ সেনা অফিসারদের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রেফতার ও প্রমোশন বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ সিন্ডিকেটে প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত একটি অংশ যেমন জড়িত রয়েছে পাহাড়িদের মধ্য থেকেও বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে দুর্বৃত্ত প্রকৃতির কিছু লোক সে সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়েছে। এদের কাজ হলো সাধারণ জনগণ ও আন্দোলনকারী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও অস্ত্র গুঁজে দিয়ে সন্ত্রাসী সাজিয়ে সেনাবাহিনী প্রমোশন লাভের বলি বানানো। সম্প্রতি মহালছড়ি থেকে সুপায়ন চাকমা নামে এক সাধারণ কাঠ ব্যবসায়ী আটক ও পানছড়িতে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে একদল পাহাড়ি দুর্বৃত্ত কর্তৃক গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের ২ নেতাসহ ৪ জনকে অপহরণের পর সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া এবং তাঁদেরকে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে সাজানো মিথ্যা মামলা দায়েরের ঘটনাকে এ যৌথ সিন্ডিকেটের উজ্জ্বল উদাহরণ বলে বক্তারা মন্তব্য করেন। বক্তারা ৯৩-এর চেতনায় শানিত হয়ে এ নব্য অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার কাছে আহ্বান জানান।
বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অফিসারদের বদলী মানে দুবাই কামাই আখ্যায়িত করে বলেন, নিরাপত্তার অজুহাতে পর্যটনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক সেক্টরে জড়িয়ে পড়ছে সেনাবাহিনী। সেনাসৃষ্ট তথাকথিত উন্নয়ন তত্ত্ব এ পর্যটন শিল্প এক শ্রেণির মুনাফাখোর পুঁজিবাদী দুর্বৃত্তদের পোয়াবারো হলেও পাহাড়ি জনগণের কাছে তা অভিশাপ। এ পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার ফলে পাহাড়িরা ভূমি থেকে উচ্ছেদসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে।
সভায় শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, ৯৩-এর ঐতিহাসিক প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ও গণমান্য ব্যক্তিবর্গসহ শতাধিক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভার আগে ভোরে দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরতে শহরের রেড স্কোয়ারসহ নারাঙহিয়ে, কালচারাল ইনস্টিটিউট ও জামতলা এলাকায় রঙিন পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। রেড স্কোয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত ব্যানার টাঙানো হয়েছে।
প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও ভোর ৬টায় পিসিপি’র অকুতোভয় একটি টিম ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে রাস্তার দু’পাশে রঙিন পতাকা সজ্জিত করে এবং বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত ব্যানার টাঙায়, যা পার্শ্ববর্তী লোকজনকে আকৃষ্ট করে।এ সময় স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রী, পথচারী ও এলাকার জনগণের মাঝেও বেশ কৌতুহল উৎসুক্য পরিলক্ষিত হয়।
পতাকা ও ব্যানার টাঙানো শেষে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’র দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
উল্লেখ, ১৯৯৩ সালের ৩০ অক্টোবর খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক কার্যলয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট পালনের লক্ষ্যে খেজুর বাগান মাঠ (বর্তমান উপজেলা মাঠ) হতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের শান্তিপূর্ণ মিছিল শুরু হলে দাঙ্গা পুলিশরা বিনা উস্কানিতে হামলা চালায়। মারমুখী পুলিশকে থামাতে গেলে সর্বপ্রথম তৎকালীন পিসিপি সভাপতি ও ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর সভাপতি প্রসিত খীসা এডিশনাল এসপি‘র হাতে আক্রমণের শিকার হন। তার পর পরই পুলিশ নিরস্ত্র শত শত পিসিপি ও এইচডব্লি¬উএফ কর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জে একজনের হাত ভেঙে যায়। গুররুতরভাবে জখম হন ৩০ জনের অধিক হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কর্মী। আহত হয় ২০ জনের অধিক স্কুল-কলেজের ছাত্র। এদিন পুলিশ ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে ৩৮ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে এবং ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে প্রতিবাদী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। কিন্তু অকুতোভয় বীর জনতা ব্যাপক প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। পরে প্রশাসন নত স্বীকার করে আটক পিসিপি নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। সেদিন রাতেই নারাঙহিয়া চৌমুহনীতে মুক্তিপ্রাপ্ত নেতা-কর্মীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং নারাঙহিয়া চৌমুহনীর নামকরণ করা হয় “রেড স্কোয়ার।” এ ঘটনার পর থেকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ৩০ অক্টোবর দিনটিকে ‘অশুভ শক্তি প্রতিরোধ দিবস‘ হিসেবে পালন করে আসছে।
————–
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।