গোপন তথ্য ফাঁস: সেনাবাহিনী সংস্কারবাদীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ যোগান দিচ্ছে

0

খাগড়াছড়ি॥ পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি সৃষ্টি ও পাহাড়িদের নিজেদের মধ্যে সংঘাত জিইয়ে রাখতে আর্মিরা জেএসএস সংস্কারবাদী ও নব্য মুখোশ বাহিনীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ যোগান দিচ্ছে এবং এমনকি ইউপিডিএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে হামলায় তাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে।

সম্প্রতি সংস্কারবাদী ও নব্য মুখোশ বাহিনী থেকে বেরিয়ে আসা কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলে এ আতঙ্কজনক তথ্য জানা গেছে।

সংস্কারবাদী দলের সশস্ত্র গ্রুপের ‘সার্জেন্ট’ ধর্মজয় ত্রিপুরা (৩৪) সিএইচটি নিউজ ডটকমের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে তার বিভিন্ন সশস্ত্র এ্যাকশনে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।

তিনি বলেন পেলে বাবু ও অন্যান্য শীর্ষ সংস্কারবাদী নেতাদের নির্দেশ অনুযায়ী তাকে ইউপিডিএফ এর বিরুদ্ধে বহুবার এ্যাকশনে যেতে হয়েছে।

সাজেকে তিন জনকে হত্যা
গত ২৮ মে সাজেকের গঙ্গারাম করল্যাছড়িতে তিন ইউপিডিএফ সদস্যকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল বলে ধর্মজয় ত্রিপুরা জানান।

# ধর্মজয় ত্রিপুরা

তিনি বলেন, ‘গঙ্গারামের করল্যাছড়িতে ইউপিডিএফ কর্মীদের উপর হামলা করতে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে আমাদেরকে মধ্যরাতে খাগড়াছড়ির তেঁতুলতলা থেকে মাজলং নেওয়া হয়। এ সময় আর্মিদের একটি দল আমাদের স্কট দেয়। মাজলঙে আর্মিরা আমাদের হাতে ৪টি এসএমজি তুলে দেয়। সাথে দেয় প্রতিটির জন্য ৩০ রাউন্ড গুলিভর্তি ম্যাগাজিন। এরপর তারা আমাদেরকে বাঘাইহাটের লাদুমণি বাজারের পাশে দ্বপধা নামক স্থানে নামিয়ে দেয়।’

তিনি আরো জানান আর্মিদের সহযোগিতায় তরু, বিধান, টনক ও তুজিমরা ৮টি হাতিয়ার নিয়ে আগে থেকেই সেখানে তাদের অপেক্ষা করছিল। তার ভাষ্য মতে ‘আমাদের ৮টি এবং আর্মিদের দেয়া ৪টি মিলে মোট ১২টি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে আমরা গঙ্গারাম করল্যাছড়িতে ইউপিডিএফ কর্মীদের উপর সশস্ত্র হামলা করি।’

উল্লেখ্য উক্ত হামলায় কমপক্ষে ৩জন নিহত এবং বেশ কয়েক জন আহত হন । ধর্মজয় ত্রিপুরা জানান হামলা শেষে আর্মিদের দেয়া বন্দুকগুলো আবার তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘হামলার পর সকালে আমরা লোকজনকে দেখাতে কৌশল করে বাঘাইহাট জোনকে পাশ কাটিয়ে দীঘিনালা-বাঘাইহাটের মূল রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে দশ নম্বর আর্মি ক্যাম্পের পাশে চুগুনোছড়ায় যাই। সেখানে একটা গাড়ি নিয়ে একদল আর্মি আমাদের সাথে দেখা করে।

‘করল্যাছড়ি এ্যাকশনটি সফল করতে পারায় তারা আমাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ দেয়। এরপর তারা তাদের দেয়া ৪টি এসএমজি আবার ফেরত নিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে টা-টা দিতে দিতে মাজলং-এর দিকে চলে যায়।’

দীঘিনালার নৌকাছড়া হেডম্যানপাড়ার বাসিন্দা ধর্মজয় ত্রিপুরা গত ৭ জুলাই জেএসএস সংস্কারবাদী দল ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। তিনি ২০০৭ সালে এ দলের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।

সংস্কারবাদী দল ত্যাগ করা অপর এক সদস্য এবং নানিয়াচরের নানাক্রুম গ্রামের বাসিন্দা শান্ত চাকমার মতে আর্মিরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা না করলে সংস্কারবাদী ও নব্য মুখোশ বাহিনীর কোন অস্তিত্ব থাকবে না।

সংস্কারবাদীদের সাথে আর্মিদের সামরিক সহযোগিতার দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একবার সংস্কারবাদীরা ইউপিডিএফের ঘাঁটি বলে পরিচিত খাগড়াছড়ির গিরিফুল এলাকায় যায়। এটা খুব সম্ভব ২০ মের ঘটনা। তখন সবাই ধারণা করছিল সেখানে ইউপিডিএফ এর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হবে। এ জন্য আর্মিরা আমাদেরকে প্রায় ৩০০ বুলেট দিয়েছিল।’

দীঘিনালার আমতলির ঘটনা
ধর্মজয় ও শান্ত উভয়েই দীঘিনালার আমতলিতে সেনাবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ ধরা পড়া ও ছাড়া পাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেন। তারা দু’জনই ১৭ জুনের ঐ ঘটনার সময় ছিলেন বলে জানান।

# শান্ত চাকমা

শান্ত চাকমা বলেন, ‘একবার আমরা ১১ জন দীঘিনালা সদরের পাশে আমতলি এলাকায় গিয়েছিলাম ইউপিডিএফ কর্মীদের উপর হামলা করতে। আমাদের হাতে ছিল ৯টি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কিন্তু আমাদের আগে সেদিকে যে একটা আর্মি গাড়ি গেছে তা আমরা জানতাম না। আর সম্ভবত আর্মিরাও জানত না আমরা আমতলায় রয়েছি। কিছুক্ষণ পর তারা গাড়িতে করে ফিরছিল। ফলে রাস্তায় আমাদের তিন জন জনপ্রিয়, শান্তি ও মিশন সশস্ত্র অবস্থায় একেবারে তাদের মুখে পড়ে।

‘আর্মিরা সাথে সাথে তাদের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো কেড়ে নেয় এবং তিন জনকেই গাড়িতে তোলে। এ সময় তারা নিজেদেরকে কখনো সংস্কারবাদী দলের সদস্য, কখনো ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ (নব্য মুখোশ বাহিনী) সদস্য, আবার কখনো আর্মিদের লোক বলে পরিচয় দিতে থাকে। ঠিক সে সময় আর্মিদের উপর মহল থেকে ফোন আসে, “ওরা আমাদের লোক, তাদেরকে কিচ্ছু করা যাবে না, এখনিই ছেড়ে দাও।”

‘এরপর আর্মিরা তাদের তিন জনের পিঠে হাতবুলিয়ে তিনটা এসএমজি আবার ফেরত দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে মুশকি হেসে চলে যায়।’

ধর্মজয় ত্রিপুরাও উক্ত ঘটনা সম্পর্কে একই বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘তরু (নব্য মুখোশ সর্দার) জনপ্রিয়দের ধরা পড়ার বিষয়টি পেলে বাবুকে মোবাইলে জানায়। সে পেলেকে কী বলেছিল তা জানি না, তবে তার ফোনের পরই আর্মিদের কাছে জরুরী ফোন আছে এবং আমাদের তিন জনকে ছেড়ে দেয়।’

এক আর্মির ঘুষি
সংস্কারবাদী দল ছেড়ে আসা নব্য মুখোশ বাহিনীর নিহত সর্দার তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার শ্যালক সুমেন্টু চাকমা (৩৮) জানান নানিয়াচর এলাকায় সংস্কারবাদী ও নব্য মুখোশদের সর্বমোট ১২টি হাতিয়ার রয়েছে, এর মধ্যে একটি প্রগতি ও আর একটি রূপমের ব্যক্তিগত হেফাজতে। বাকি ১০টি হাতিয়ার নিয়ে তারা আর্মিদের সহায়তায় ঘুরাফেরা করে থাকে।

# সুমেন্টু চাকমা

আর্মিদের সাথে নিয়ে একটি এ্যাকশনে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুমেন্টু বলেন, ‘বধিল কান্তি, বিঝু ময়, অন্ন বিজয় ও আমি একবার নানিয়াচরের গবছড়িতে ৯০জন আর্মি নিয়ে ইউপিডিএফ সদস্যদের উপর হামলা করতে গিয়েছিলাম। এটা ১৯ জুনের ঘটনা। কিন্তু ইউপিডিএফের কোন সদস্যকে পাইনি। অপারেশন ব্যর্থ হওয়ায় আর্মিরা আমাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এক সেনা জোয়ান আমাকে একঘুষি মেরে বলে, “শালারা তোমাদের কারণে আজ আমাদের এত কষ্ট হচ্ছে, সারারাত একদ- ঘুমানোর সময় পাচ্ছি না।”’

দুই নেত্রী অপহরণ
বহুল আলোচিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে অপহরণের ঘটনার সাথে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় নব্য মুখোশ বাহিনী থেকে ফিরে আসা পাভেল চাকমার জবানে।

নানিয়াচরের দজর  পাড়ার (১৭ মাইল) বাসিন্দা পাভেল চাকমা ১১ জুলাই সেনা-সৃষ্ট নব্য মুখোশ বাহিনী ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে চলে আসেন। উপরোক্ত ১৮ মার্চের অপহরণ ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘কুদুকছড়ির আবাসিকে হামলা ও দুই নারী নেত্রীকে অপহরণ সম্পূর্ণ আর্মিদের সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছিল। তারা আমাদেরকে ১৭ মার্চ রাত ১০টার দিকে নানিয়াচরের রাস্তামাথা থেকে সামনে পিছনে স্কট দিয়ে কুদুকছড়ি এলাকায় পৌঁছে দেয়।’

তার পরদিন সকালে তারা ব্রাশ ফায়ার করে ডিওয়াইএফ নেতা ধর্মসিং চাকমাকে গুরুতর আহত করে, একটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং দুই নারী নেত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

# পাভেল চাকমা

তার ভাষ্য মতে, ‘এসবই ঘটেছে আর্মিদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে। আমরা কোথায় কিভাবে কতজন অবস্থান করি সেসবই তাদেরকে জানাতে হয়। তাদের সাথে আমাদের প্রায়ই সশস্ত্র অবস্থায় দেখা হয় এবং আমাদের বন্দুকগুলি দেখে তারা প্রশংসা করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘মূলত অর্মিরা সব ধরনের সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দেয় বলেই আমরা এত কিছু করতে পারি। তারা স্কট না দিলে আমরা কোথাও যেতে পারি না। সেটাও এক ধরনের বন্দী জীবনের মতো। তরুকে পর্যন্ত বলতে শুনেছি “আর্মিরা সেল্টার না দিলে আমরা খাগড়াছড়িতেও থাকতে পারব না।”’

ধর্মজয় ত্রিপুরা জানান পেলে, সুদর্শন, বিধান এবং আরো অনেক সংস্কারবাদী নেতা আর্মিদের ব্রিগেড ও জোনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে কাজের পরিকল্পনা করে থাকে এবং সে অনুসারে তাদেরকে কাজ করতে হয়। তার ভাষায় সংস্কারবাদীরা কোন রাজনেতিক দল নয়, তারা পুরোপুরি সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবাহী গোলাম দলে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দিয়ে অনেক ক্ষতিকর কাজ করানো হয়েছে, তার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই লজ্জিত এবং অনুতপ্ত।’
—————–
সিএইচটিনিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More