চিম্বুক পাহাড়ে পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি পেশ

0

বান্দরবান।। বান্দরবান চিম্বুক পাহাড়ের উপর পাঁচ তারকার হোটেলসহ বিলাসবহুল পর্যটনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার দাবি জানিয়ে কাপ্র্যু পাড়া , দোলাপাড়া ও এরাপাড়াবাসী এবং চিম্বুক পাহাড়ে বসবাসরত ম্রো জনপ্রিতিনিধিবৃন্দ বান্দরবান জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আজ স্মারকলিপি পেশ করেছেন।

এই স্মারকলিপিতে প্রায় দেড়শজন সাক্ষর দিয়েছেন।

স্মারকলিপিতে তারা বলেন, গত ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে ট্রিবিউন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে চিম্বুক পাহাড়ে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী চট্টগ্রামের ২৪তম পদাতিক ডিভিশন ও বান্দরবানের ৬৯ পদাতিক বিগ্রেডের সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং সিকদার গ্রুপ (আর এ্যান্ড আর হোলডিংস) এর যৌথ উদ্দ্যোগে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে।

হোটেল ম্যারিয়ট নামের এই পাঁচ তারকা হোটেলে মূল হোটেল বিল্ডিং এর সাথে থাকবে আলাদা ১২টি বিলাসবহুল ভিলা, আধুনিক ক্যাবল রাইড ও সুইমিং পুল। সাম্প্রতিককালে পর্যটনের নামে সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ও কিছু করপোরেট কোম্পানীর ক্রমাগত ভূমি দখল করার কারনে স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীদের সেখানে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ওয়াইজংশন, চিম্বুক চূড়া এলাকা, কাপ্রু পাড়া এলাকায় নীলগিরি নাম দিয়ে ভূমি দখল করেছে। একইভাবে একই চিম্বুক রেঞ্জের আলীকদম লামা সড়কের ডিম পাহাড়ে ২১ কিলোমিটার থেকে ২৬ কিলোমিটারে প্রায় ৬ কিলোমিটার এলাকা সেনাবাহিনী সংরক্ষিত এলাকা সাইনবোর্ড দিয়ে রেখেছে। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ১৯৮০ এর দশকে অশান্ত পরিস্থিতির সময় ঐ এলাকায় উচ্ছেদ কুলিং ম্রো পাড়াটির পুঃস্থাপনেও বাধা দেওয়া হচ্ছে।

মোট অবৈধ দখলের জমির অবস্থান এবং পরিমাণ হচ্ছে, বান্দরবান – চিম্বুক- থানচি সড়কের ৪৭ কিলোমিটার কাপ্রু ম্রো পাড়া (সেনাবাহিনী পরিচালিত নীলগিরি অবকাশ যাপনকেন্দ্র এলাকা) থেকে নাইতং পাহাড় (সেনা কল্যাণ ট্রাস্টের দেওয়া নাম চন্দ্রপাহাড়) হয়ে ৫২ কিলোমিটার জীবননগর পর্যন্ত। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জায়গার এলাকা। জমির পরিমাণ আট শতাধিক (৮০০) একর।

করোনা ভাইরাসের দুর্যোগের সময় বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে সেনা কন্যাণ ট্রাস্ট ও এক্সিম ব্যাংকের এমডি হত্যা চেষ্টা মামলার পলাতক আসামিদের সিকদার গ্রুপ (আর এ্যান্ড আর হোলডিংস), উপরের বর্ণীত অবস্থানে আট শতাধিক একর জমি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দখল করছে।

সম্পূর্ণ অবৈধ এবং বেআইনিভাবে দখল করা এ জমিতে দোলাপাড়া , কাপ্রুপাড়া ,এরা পাড়ার শতাধিক ম্রো পরিবার বংশপরম্পরায় বহু প্রজন্ম ধরে ফলজ এবং বনজ বাগান করে জীবনধারণ করে আসছে। বর্তমানে তাদেরকে তাদের নিজেদের জমি ও বাগানেও সেনাবাহিনীরা ঢুকতে দিচ্ছেনা।

স্মারক লিপিতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই বিশাল এলাকার জরিপ করে বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড ও খুটি বসিয়ে দেয় , এতে করে পাড়াবাসীর শত শত বছরের সংরক্ষিত পাড়া বন, শশ্মানভূমি , জুম চাষের জমি , ফলজ-বনজ বাগানের সবকিছু দখলে চলে গিয়েছে। এই অবস্থায় কাপ্রু পাড়া, দোলাপাড়া ও এরাপাড়া উচ্ছেদ হবে। একইভাবে মার্কিনপাড়া, লংবাইতং পাড়া, মেনসিং পাড়া, রিয়ামানাইপাড়া ও মেনরিং পাড়া উচ্ছেদের মুখে পড়েছে। স্থানীয় সেনাক্যাম্প থেকে পাড়ার কার্বারী ও পাড়াবাসীদের ডেকে দখলকৃত জায়গা জমি নিয়ে কোনো কথা না বলার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে।

সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ও সিকদার গ্রুপের দাবী অনুসারে ২০০৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে (স্মারক প্রম/ই-৩/২০০৬/ডি-৯/২৬৭ তারিখ ১১.০৭.২০০৭) ১৬ একর জমি বান্দরবান সেনাজোনের নামে আবেদন করা হয়। দেখা গেছে ঐ আবেদনে ১৬ একর জমির অবস্থান প্রথমে জীবননগর উল্লেখ করা হয়ছে। একই আবেদনে আবার একই ১৬ একরের অবস্থান ৩৫৫ নং সেপ্রু মৌজার কাপ্রুপাড়ায় বলা হয়েছে।

এখন ব্যাপার হচ্ছে, প্রথমত বেসরকারী বা প্রাইভেট কোম্পানী সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ও শিকদার গ্রুপের ব্যবসার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জমি বন্দোবস্তের আবেদন কি আদৌ করা যায়? দ্বিতীয়ত, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৬ একর জমির আবেদনে প্রায় আটশত একরের চৌহাদ্দি দেওয়া হবে। যা কোনো মতে যুক্তি সংগত নয়।

এই সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট কোনো সরকারী প্রতিষ্ঠান নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর নাম ভাঙিয়ে এবং সেনাবাহিনীর প্রহরায় জমি দখল যেমন বেআইনি তেমনি সেনাবাহিনীর মানবাধিকারের ভাবমূর্তির জন্যেও ক্ষতিকর। যে সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তি রক্ষায় গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে, সেই সেনাবাহিনী বিতর্কিত করপোরেট প্রতিষ্ঠান সিকদার গ্রুপের সঙ্গে যোগসাজন করে নিজ দেশের অনগ্রসর পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শুধুমাত্র খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অবলম্বন – ভূমি দখল করলে মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হবে। দখলকৃত ভূমিতে বিলাসবহুল হোটেল ও পর্যটন হলে একদিকে ম্রো জনগোষ্ঠী উচ্ছেদ হবে অপরদিকে স্থানীয়,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বিতর্কিত হয়ে পড়বে।

স্মারক লিপির পরিশেষে দখল হওয়ার পাড়ার ম্রো অধিবাসীরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানায় যে, দখল বন্ধ না হলে এবং সেখানে বিলাসবহুল হোটেল ও পর্যটন নির্মাণ করা হলে ম্রোরা তাদের চিরচেনা পরিবেশকে হারিয়ে ফেলবে যার কারণে সেখানে ম্রোদের টিকে থাকাটা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

তাদের চিরচেনা নাইতং পাহাড় চূড়ার নাম বদলে হয়ে গিয়েছে চন্দ্র পাহাড়, এভাবে করে শুধু এই উল্লেখিত আটটি পাড়া নয়, সমগ্র চিম্বুক পাহাড়ের ম্রোরা টিকে থাকতে পারবেনা। অপরদিকে পাহাড় কেটে বিলাসবহুল হোটেল স্থাপনা এবং শত শত কর্মকর্তার বাসস্থান নির্মাণ ও পাহাড়ের জলধারায় ও ঝর্নায় বাধ নির্মাণ করা হলে প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি দাঁড়াবে। এই ধরণের ভূমি দখল পার্বত্য ‘শান্তিচুক্তি’ ও পার্বত্য অঞ্চলের বিদ্যমান আইন কানুনেরও লঙ্ঘন ঘটায়।

সূত্র: জুম্ম ভয়েস

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More