ঢাকায় দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির সংহতি সমাবেশ
সিএইচটিনিউজ.কম
ঢাকা প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালায় ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বানে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় হামলার প্রতিবাদ, আটকদের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, হয়রানি বন্ধ, বিজিবি ব্যাটেলিয়ন সদর দপ্তর সরিয়ে নেয়া এবং উচ্ছেদ-হওয়া ২১পরিবারকে জমি ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে আজ ২০ মার্চ শুক্রবার বিকেল চারটায় ঢাকায় জাতীয় যাদুঘরের সামনে দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে এক সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন সহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
সমাবেশে ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক পরিতোষ চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন প্রফেসর আনু মহাম্মদ (তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব), জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, দীঘিনালা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান সুসময় চাকমা, কবাখালি ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বকল্যাণ চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি মাইকেল চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি থুইক্যচিং মারমা। সভা পরিচালনা করেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অংগ্য মারমা।
সমাবেশে উপস্থিত থেকে সংহতি প্রকাশ করেছেন মঙ্গলধ্বণির সম্পাদক শাহরিন আরাফাত, গণমুক্তি গানের দলের নাট্য সম্পাদক নাহিদ সুলতানা লিসা, জ্ঞানালোক ধর্মীয় শিক্ষা পরিষদের জুয়েল বড়ুয়া। সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন ৪নং দীঘিনালা ইউপি চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা, বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদকৃত শশী মোহন পাড়ার কার্বারী নতুন চন্দ্র চাকমা, গোপাদেবী চাকমা ও তার মেয়ে অপ্সরী চাকমা। এছাড়া হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমাও উপস্থিত ছিলেন। ঢাকাস্থ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন সমাবেশে অংশ নিয়েছেন।
প্রফেসর আনু মহাম্মদ দীঘিনালা ভূমিরক্ষা কমিটির বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ একমত বলে ঘোষণা দেন এবং কমিটির উত্থাপিত দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে আরও বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত থাকলে বাংলাদেশও অশান্ত থাকবে। পাহাড়ে যে নির্যাতন ও দখলদারিত্ব চলছে তার সাথে শুধু সেনাবাহিনী আর আমলারা নয়, পাহাড়িদের মধ্য থেকেও একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী এর সাথে যুক্ত ও লাভবান হচ্ছে। ‘৯৭ সালে যে ‘শান্তিচুক্তি’ হয় তাতে নির্দিষ্ট পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নি, তা আমরা সবাই জানি। পাহাড়ের অধিবাসী যাদের সবাইকে জুম্মো বলা হয়, তাদের মধ্যেও বিভেদ তৈরি হয়েছে। লড়াইয়ে ঐক্য না থাকায় লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। পাহাড়িদের নিজেদের মধ্যে যেমন ঐক্য প্রয়োজন, তেমনি সমর্থকদের সাথেও ঐক্য গড়া দরকার। পাহাড়ে যে নির্যাতন নিপীড়ন আর দখলদারিত্ব চলছে তাতে শুধু পাহাড়িরা নয় সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্ব শুধু পাহাড়িদের নয়, অন্যদেরও দায়িত্ব আছে। বাঙালিদের মধ্যে যারা সংবেদনশীল তাদের সাথে ঐক্য সম্প্রসারিত করতে হবে।’
আনু মহাম্মদ আরও বলেন,‘দেশের মোট জনসংখ্যার ৯৯ ভাগ বাঙালি হলেও এদেশে আরও বহু জাতি আছে। হিন্দু বৌদ্ধসহ ধর্ম বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী অনেকে আছে, রাষ্ট্রটা সবার। এটি একটি বহু জাতিক রাষ্ট্র। যে লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সংবেদনশীলতা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারে নি। জাতিগত সংঘাত বিদ্বেষ ও বৈষম্য বেড়েছে।’
ব্যারিস্টার জ্যেতির্ময় বড়ুয়া তার বক্তব্যে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের চেয়ে সেটলারদের সংখ্যা বছর বছর বেড়ে যাচ্ছে। এক সময় সেটলাররাই সংখ্যাগুরু হয়ে পড়বে। হিসেব করলে পাহাড়িদের চেয়ে সেনা আর সেটলারের সংখ্যা বেশী হতে পারে। সারা দেশে ৪৮০০০ একর জমি সেনাবাহিনীকে দেয়া হয়েছে। দেশের সবচেয়ে ভাল, লোভনীয় জমি অবৈধভাবে সেনাবাহিনীকে দেয়া হচ্ছে। দেশের সংবিধানে এভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস করে কোন সংস্থাকে জমি দেয়ার বিধান নেই।’ যাদের ক্ষমতা আছে আইন কী তাদের জন্য তা তিনি প্রশ্ন রাখেন।
তিনি আরও বলেন, ‘মেজরিটির আগ্রাসন চালানোর ক্ষমতা রয়েছে। সংখ্যায় কমদের ওপর চলছে আগ্রাসন নির্যাতন। অতীতে তা দেখা গেছে, ভবিষ্যতেও তার আলামত স্পষ্ট। এককভাবে কাযকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়, তার জন্য সবাই মিলে আন্দোলন করতে হবে। মি. বড়ুয়া দীঘিনালায় শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় হামলা, যশোহরে হামলা, রামুতে হামলা বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেন এবং তীব্র নিন্দা জানান।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম তার বক্তব্যে দীঘিনালা শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় সেনা-পুলিশের হামলা, ধরপাকড় ও মিথ্যা মামলার তীব্র প্রতিবাদ জানান। ডেস্টিনি নামের এনজিওসহ সেনা-আমলাদের পাহাড়ের হাজার হাজার একর জমি ইজিরা নেয়ারও সমালোচনা করেন।
ফজুল হাকিম ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও এরা সংবিধান সভা করেনি। জনগণের মতামত গ্রহণ করেনি। দেশে বাঙালি ভিন্ন আরও ৪৫টির অধিক জাতিসত্তা রয়েছে, তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। ৫ জানুয়ারি ভোটারহীন এক নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমানে এরা অবৈধভাবে ক্ষমতায় রয়েছে।’
ফয়জুল হাকিম তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘দেশের জনগণকে দুর্যোগে ফেলে ‘৭১ সালে নেতারা আত্মসমর্পণ করেছিলেন তার ময়না তদন্ত করা দরকার। দীঘিনালা বাবুছড়ায় নির্যাতন চলছে, শুধু সেখানে নয় দিনাজপুর, রাজশাহীসহ সর্বত্র সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর নিপীড়ন চলছে। দেশের কৃষক শ্রমিক সাধারণ জনগণেরও এদেশে অধিকার নেই। তিনি রাণা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন।
তিনি তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে পাহাড় সমতলে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সমবেশে দীঘিনালা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান সুসময় চাকমা, কবাখালি ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বকল্যাণ চাকমা ও ভূমি রক্ষা কমিটির সভাপতি পরিতোষ চাকমা বাবুছড়ায় ভূমি বেদখলের চিত্র তুলে ধরেন এবং আন্দোলনে সংহতি জানানোর জন্য উপস্থিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ধন্যবাদ জানান।
সমাবেশ শেষে যাদুঘরের সামনে থেকে একটি মিছিল টিএসসি ঘুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
———————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।