ঢাকায় পিসিপি’র শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
ঢাকা : বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’র উদ্যোগে “পার্বত্য চট্টগ্রামে ঔপনিবেশিক শিক্ষা, বর্তমান সংকট উত্তরণে ছাত্র-যুব সমাজের ভূমিকা” শীর্ষক আলোচনা সভা গতকাল ২৬ সেপ্টেম্বর (সোমবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন পিসিপি’র সভাপতি সিমন চাকমা। প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, ইউপিডিএফ নেতা সচিব চাকমা, বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি হাসিবুর রহমান ও আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
সভা পরিচালনা করেন পিসিপি’র সাধারণ সম্পাদক বিপুল চাকমা।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, আব্দুল হামিদ খান ভাষানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবু নোমন খান, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এমএম পারভেজ লেনিন, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমা, পিসিপি’র সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ সংগঠক মিল্টন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমা, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের সভাপতি বিপ্লব ভট্টচার্য্য, ছাত্র গণমঞ্চের সাধারণ সম্পাদক নূর সুমন, মুক্তির মঞ্চের আহ্বায়ক গণসংগীত শিল্পী হেমন্ত দাশ।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না। সেখানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু শিক্ষকের বড় অভাব রয়েছে। এ অভাব নিজেদের মধ্যে থেকে ; যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী থেকে পূরণ করতে হবে। যদি নিজেদের জাতিগোষ্ঠী থেকে শিক্ষক পাওয়া না যায়, তবেই কেবল বাঙালি শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, জিয়াউর রহমানের সময় সেটলার পূণর্বাসন করা হয়েছিল। এখন কোন সরকারই তাদের ফিরিয়ে আনতে চাইবে না। এর জন্য আন্দোলন করতে হবে, জাতিসত্তাসমূহকে নিজস্ব শক্তি অর্জন করতে হবে, শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। শক্তি না থাকলে শাসকগোষ্ঠী কোন তোয়াক্কা করে না। নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিতে হবে।
হাসিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ এক ভাষার দেশ নয়, বহু ভাষার দেশ। এই যে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের যে মানসিকতা তৈরী করে দিয়েছে তার থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। এই শিক্ষা কেবল বাংলা ভাষিদের জন্য নয়, এই শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সারা দেশে জারি রাখা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের সমগ্র জনগণকে ঔপনিবেশিক ও পরাধীনতার মানসিকতার মধ্যে নানাভাবে আঁকড়ে রেখেছে। হয়তো আমরা স্বাধীন বা মুক্তি চাচ্ছি, আমরা সংগ্রাম করছি মুক্তির জন্য, কিন্তু একি সঙ্গে মানসিকতার দিক থেকে অনেকভাবে পশ্চাদপদতা, পরাধীনতার খুঁটিতেও বাঁধা পড়ে আছি। এই বাঁধাটাকে অতিক্রম করতে হলে ভাষাও একটা অবলম্বন হতে পারে। ভাষা কেবল মূখের ভাষায় সীমিত থাকলে হবে না, এটা সাহিত্যের ভাষা এবং জ্ঞান চর্চার ভাষা হয়ে উঠতে হবে বলেও মত প্রকাশ করেন।
তিনি আরো বলেন, ৭২ -এর সংবিধানের কথা বিভিন্ন সময় বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সেখানেও জাতিসত্তার স্বীকৃতি ছিল না। ২০১১ সালে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয় এর দ্বারা মূলত ৭২ -এর সংবিধানের সেইসব ধারাগুলোকেই চিরস্থায়ী করা হয়েছে। এটা এমনভাবে করা হয়েছে যা কোনসময় পরিবর্তন করা যাবে না। সুতরাং বর্তমান সংবিধানের আলোকে জাতি স্বীকৃতি, ভাষা স্বীকৃতি কোনদিন হবে না। যখন সংবিধান দ্বারা কিছুই হবে না তখন এই সংবিধানের প্রয়োজনও আর থাকে না। সংবিধান আমাদেরকে একহাতে অধিকার দিয়েছে কিন্তু আর একহাতে সবকিছু কেড়েও নিয়েছে।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) একটি রাজনৈতিক সংগ্রামী সংগঠন উল্লেখ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামই হলো দেশের সবচেয়ে বড় সামরিকীকরণ এলাকা। যেখানে নিয়ত দমন পীড়ন চলছে। এর বিরুদ্ধে একটা প্রবল শক্তি, প্রতিরোধ ও স্পর্ধা নিয়ে বাংলাদেশের এক দশমাংশের একটি ভূখণ্ডে দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ধারাাহিকভাবে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি ভূমি দখল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমাগতভাবে ভূমি দখল করে নেয়া হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলে খাসিয়া পুঞ্জি, বাঁশখালিতে, গোবিন্দগঞ্জে জমি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে, মধুপরে সংরক্ষিত বনাঞ্চালের নামে গারো মান্ডি জাতিসত্তাদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। সারাদেশের জনগণ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে কেন? যে দেশের স্বাধীনতা এসেছিল একটা ভাষার লড়াইয়ের মাধ্যমে, সেখানে কেন অন্য ভাষাকে স্থান দেয়া হবে না? ভাষা আন্দোলন হয়েছিল অন্য ভাষার আগ্রাসন থেকে নিজ ভাষাকে মুক্ত করার জন্য, আর আজকে কেন অন্যদের ভাষার ওপর আগ্রাষন চালানো হচ্ছে?
২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা বলতে গিয়ে তিনি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ এর উপ-অনুচ্ছেদ ২ এর উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে বলা আছে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাঙালি হিসেবে পরিচিত হইবেন’। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, নাগরিক হিসেবে আমি বাংলাদেশী হতে পারি, কিন্তু জাতি হিসেবে একজন মারমা, একজন চাকমা, একজন ত্রিপুরা, একজন গারো বা বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতির মানুষ সে কিভাবে বাঙালি হতে পারে? সংবিধান কেন কেবল বাঙালি জাতিকে স্বীকৃতি দেবে আর অন্য জাতিগুলোকে স্বীকৃতি দেবে না?
তিনি আরো বলেন, সরকারীভাবে জাতিসত্তাগুলোকে যে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলা হয়েছে, আমি এই শব্দকে অপমানজনক বলে মনে করি এবং শুরু থেকে আমি তার বিরোধী। শুধু তাই নয়, সংবিধানে এখনো উপজাতি শব্দটি বহাল আছে। এটাই প্রমাণ করে যে, সমাজে কিভাবে ভেদাভেদ সৃষ্ঠি করতে হবে, অসাম্য তৈরী হবে তা সংবিধান সরকারকে শিখিয়ে দিচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক ১১ নির্দেশনা দিয়ে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনকে সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, একজন বিদেশী সে যা ইচ্ছা যখন খুশি পার্বত্য চট্টগ্রামে যেতে পারবে না, যার-তার সাথে কথা বলতে পারবে না……, কেন? তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কি যুদ্ধাবস্থা? যদি তাই-ই হয় তবুও কোন কোন মৌলিক অধিকার ডিসফাংশনাল হয়ে যাবে তাও সংবিধানে পরিস্কার উল্লেখ আছে। এসময় তিনি তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারারও সমালোচনা করেন। তিনি এই ধারায় আটক মিঠুন চাকমা ও দীলিপ রায়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই আইন দমন-পীড়নমূলক একটি অপআইন।
সভাপতির বক্তব্যে সিমন চাকমা বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত শক্ত করার লক্ষ্যে আশু জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করা তার মধ্যে একটি, কিন্তু তা বন্ধের কোন পদক্ষেপ নেই। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ দেখা যায় না। প্রয়োজনীয় শর্ত তৈরি না করে সরকার তড়িঘড়ি করে মেডিক্যাল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করছে, এ নিয়ে অনেক প্রতিবাদ আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও সরকার তা আমলে নেয় নি।
বারে বারে আমরা লক্ষ্য করছি, জনগণ যা চায় এবং দাবি করে, সরকার তা কর্ণপাত করে না। অথচ যা জনগণ চায় না, আপত্তি করে প্রতিবাদ জানায়, বন্ধের দাবি তোলে– এমন বিষয় সরকারের উচ্চ মহল অতি আগ্রহ ও উৎসাহের সাথে বাস্তবায়ন করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামে। এতে সরকারের গণবিরোধী চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠে। এটি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় ঘটছে তা নয়, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। রামপাল কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যেভাবে উপজেলা পর্যায়ে কলেজ গড়ে উঠছে এবং তা সরকারের অনুমোদন লাভ করছে, সে নিয়েও আমাদের আপত্তি আছে। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের লক্ষ্যে এসব কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, এসব কলেজে শিক্ষা দেবার মত শিক্ষক বা শিক্ষা উপকরণ লাইব্রেরি, বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব্রেটরি কিছুই নেই।
মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদানের দাবি জানিয়ে আসছে পিসিপি দীর্ঘ দিন ধরে। সরকার আগামি বছর থেকে প্রাক প্রাথমিক লেভেলে পাঁচটি ভাষায় (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও ওঁরাও) চালু করতে যাচ্ছে, যা সাধুবাদযোগ্য। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, পাকিস্তান আমলেও ‘চাকমা পত্থম শিক্ষা’ নামে একটি বই প্রাথমিক স্কুলে পাঠ্যের জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ছিল বলে আমরা জানি। কিন্তু সেটা চালু করা সম্ভব হয় নি, কারণ তখন তা শিক্ষা দেবার মত যথেষ্ট শিক্ষক ছিলেন না। এখন প্রাক-প্রাথমিক লেভেলে পাঁচ ভাষায় শিক্ষার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও বিষয়টি মনে রাখা দরকার। বইপুস্তক রচনার পাশাপাশি শিক্ষক তৈরিও এক্ষেত্রে জরুরি। এজন্য আলাদা শিক্ষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা দরকার বলে আমরা মনে করি।
সভায় ঢাকাসহ বিভিন্ন কলেজ, পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পলিটেকনিক কলেজের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
_____________
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।