ঢাকায় লোগাঙ গণহত্যা দিবস পালিত
ঢাকা : পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের উদ্যোগে আজ (১০ এপ্রিল) বিকাল সাড়ে ৫ টায় ঢাকার শাহবাগ জাদুঘরের সামনে লোমহর্ষক লোগাং গণহত্যার স্মরণে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ’গণশত্রুদের বিরুদ্ধে পাহাড় ও সমতলের জনগণের সংগ্রামী মৈত্রী উর্দ্ধে তুলে ধরুন’।
সভায় সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি অংগ্য মারমা। বক্তব্য রাখেন জাতীয় মুুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের সভাপতি মাসুদ খান, গণতান্ত্রিক গণমোর্চার সভাপতি জাফর হোসেন, ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমা ও মাইকেল চাকমা। মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি বিনয়ন চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নিরূপা চাকমা।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ছাত্র গণমঞ্চের যুগ্ম আহ্বায়ক নুর সুমন, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের আহ্বায়ক জাকির সুমন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট(খালেকুজ্জামান) এর সভাপতি ইমরান হাবিব রুমন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল মাহমুদ, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ইকবাল, গণমুক্তি গানের দল-এর সংগঠক ফারজানা হক সামা প্রমুখ।
সভা পরিচালনা করেন পাহাড়ি ছাত্রদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিপুল চাকমা।
সমাবেশে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, লোগাং গণহত্যার অবশ্যই বিচার করতে হবে। শুধু লোগাঙ নয় এযাবৎ পাহাড়ে সংঘটিত সকল গণহত্যাসহ শতশত শ্রমিক গণহত্যা ও বাঁশখালি গণহত্যার বিচার করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমি ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর নান্যচর গণহত্যা গণহত্যা সংঘটিত হবার পরে তদন্ত টীমের সদস্য হিসেবে সেখানে গিয়েছিলাম। তখন অনেক লোকের সাথে কথা হয়েছে। সেখানেও দেখেছি বহু লোককে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, লোগাঙ গণহত্যার প্রতিবাদ সারা দেশে চলমান হত্যাক-ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শক্তি যোগাবে।
গণতান্ত্রিক গণমোর্চার সভাপতি জাফর হোসেন বলেন, অতীতে অবাঙালিরা বাঙালিদের উপর হত্যা নির্যাতন চালালেও বর্তমানে বাঙালিরাই বাঙালির উপর হত্যা নির্যাতন চালাচ্ছে। তিনি ময়নামতি সেনানিবাসে হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগী জাহান তনুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, তনু বাঙালি ছিল। কিন্তু বাঙালি হয়েও তাকে বাঙালির হাতে খুন হতে হলো। তাই এখন পাহাড়ি ও বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে খুনি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক গণতান্ত্রি গণমঞ্চের সভাপতি মাসুদ খান বলেন, দেশে মানুূষ ভয়ংকর এক নিরাপত্তহীনতার মধ্যে রয়েছে। ঘর থেকে বাইরে গেলে নিরাপদে বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা থাকে না। লোগাঙ গণহত্যার স্মরণসভা থেকে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণমানুষের মুক্তির লড়াইকে জোরদার করি।
বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি হাসিবুর রহমান বলেন, লোগাঙ গণহত্যা শুরুও ছিলনা, আর শেষও নয়। এর আগে ১৯৮০ সালে প্রথম কাউখালিতে ২৫ মার্চ এক গণহত্যার মধ্য দিয়ে পাহাড়ে গণহত্যা শুরু হয়েছিল। এরপর লংগদু নানিয়ারচর সহ অন্তত দশটি বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়। এসব ঘটনায় হাজারেরও বেশী পাহাড়ি মানুষ মারা যায়।
“গণশত্রুদের বিরুদ্ধে পাহাড় ও সমতলে জনগণের সংগ্রামী মৈত্রী গড়ে তুলুন” তিন সংগঠনের এই স্লোগানকে যথার্থ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে যেমন পরিকল্পিতভাবে সেনাবাহিনী গণহত্যা সংঘটিত করছে ঠিক একই ভাবে সমতলে স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টস এর ৯ তলা ভবন ধ্বসের পর সেনাবাহিনী শতশত শ্রমিককে রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলেছিল। তাই এখন পাহাড় ও সমতলে সংগ্রামী মৈত্রী গড়ে তোলা ছাড়া জনগণের সামনে বিকল্প কোন পথ নাই।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) সংগঠক মিঠুন চাকমা বলেন, লোগাং গণহত্যা সংঘটিত হবার পর সর্বপ্রথম পাহাড়ের জনগণ এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে স্বতস্ফুর্তভাবে রাজপথে নেমে হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ করেছিল, তারা তিন পার্বত্য জেলায় খররোদ্রে খালিপায়ে হেটে এই প্রতিবাদ জানিয়েছিল, শোকার্ত স্বজনহারা লোগাঙবাসীর সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করে ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব বর্জন করেছিল, সকল ধরণের আনন্দ উৎসব থেকে বিরত থেকেছিল। ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল বৈসাবি(বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু) উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য ঢাকা থেকে মানবাধিকার কর্মী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-লেখক-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পেশাজীবির একটি টিম খাগড়াছড়িতে যায়। ১১ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তারা লোগাং গণহত্যার খবর পায়। পরে উক্ত সফর দলটি ১২ এপ্রিল লোগাং এলাকায় সফর করতে চেষ্টা করলে প্রশাসন কর্তৃক তারা বাধাগ্রস্ত হয়। পরে ১৩ এপ্রিল খাগড়াছড়ি কলেজর ঐতিহাসিক কড়ইতলা ময়দানে উক্ত সফর দলটি পাহাড়ি জনগণের প্রতিবাদ বিক্ষোভে শামিল হয়। এরপর তারা ঢাকায় এসে পাহাড় ও সমতলের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সেনাশাসন ও নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৯২ সালে গণহত্যার প্রতিবাদ স্বরূপ গড়ে ওঠা সেই ঐক্য ও সংহতি আজও অটুট রয়েছে। তিনি বলেন, দেশের চলমান দুর্দিনে এই ঐক্য ও সংহতি আরো সংহত ও সুদৃঢ় করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রালয় কতৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে জারিকৃত দমনমূলক ১১ দফা নির্দেশনার কড়া সমালোচনা করে বলেন, এরকম দমনমূলক নির্দেশনার মাধ্যমে পাহাড়ের আন্দোলন দমন করা যাবে না। পাহাড়ি জনগণ জানে কিভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করে নিতে হয়। তিনি অবিলম্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রালয় কতৃক জারিকৃত দমনমূলক ১১ দফা নির্দেশনা বাতিলের দাবীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
স্মরণসভার শেষ পর্যায়ে লোগাঙ গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে অস্থায়ী শহীদ বেদীর সামনে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকাস্থ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন প্রতিশীল জাতীয় ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
——————
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।