তাইন্দংয়ে পাহাড়ি গ্রামে হামলার সাথে জড়িতদের শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণ কমিটি
প্রেস ব্রিফিং থেকে সুপারিশ আকারে ৯ দফা দাবি জানানো হয়েছে। দাবিগুলো হচ্ছে- ১. তাইন্দং-তবলছড়ি ঘটনায় পুড়ে দেওয়া ঘর-বাড়ি পুননির্মাণসহ প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ন্যুনতম নগদ ৬ লক্ষ টাকা ও ৫ বছরের জন্য রেশনিং-এর ব্যবস্থা করা, ২. ঘটনায় মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট, সম্পত্তি বিনষ্ট ও চুরি যাওয়া প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ন্যুনতম নগদ ৬ লক্ষ টাকা এবং ৫ বছরের রেশনিং-এর ব্যবস্থা করা, ৩. চুরি-করা বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার ও ভেঙ্গে দেওয়া বুদ্ধমূর্তি যথাযথ ক্ষতিপূরণপূর্বক প্রতিস্থাপনসহ পাকা বৌদ্ধ মন্দির ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে দেয়া, ৪. বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার ষড়যন্ত্রকারী, ইন্ধনদাতা ও হামলায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া, ৫. নিরাপত্তা বাহিনীর উষ্কানীমূলক অপতৎপরতা বন্ধ করাসহ যামিনীপাড়া বিজিবি জোন কমান্ডারসহ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যবস্থা করা, ৫. পাহাড়িদের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব গ্রাম প্রতিরক্ষা দল বা ভিডিপি গঠনের অনুমতি দেয়া, ৬. অনুপ্রবেশকারী সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরিয়ে নিয়ে সমতলে তাদের প্রকৃত আবাসস্থলে জীবিকার নিশ্চয়তাসহ সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করা, ৭. তাইন্দং-তবলছড়ি, মাটিরাঙ্গাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল পাহাড়িদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান, বসতভিটা-ভূমি বেদখল বন্ধ এবং পাহাড়িদের উপর সেটলার বাঙালিদের হামলা সম্পূর্ণ বন্ধ করা ও ৯. ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে হামলার পরবর্তী অনিল বরণ চাকমা বাদী হয়ে মাটিরাঙ্গা থানায় দায়েরকৃত মামলাটি চট্টগ্রামে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা।
হামলায় ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে কিরণ মারমা বলেন, তাইন্দংয়ে সেটলার হামলায় সর্বেশ্বর পাড়ায় ১৭টি, বগা পাড়ায় ১২টি, বান্দরশিং পাড়ায় ৩টি ও তালুকদার পাড়ায় ২টি সহ মোট ৩৪টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ সহ সর্বেশ্বর পাড়ায় একটি বৌদ্ধ বিহার ও একটি দোকান ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৬০ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা।
লিখিত বক্তব্যে কিরণ মারমা অভিযোগ করে বলেন, তাইন্দং ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার ফণীভূষণ চাকমাসহ ১২জনকে ক্রসিং নামক স্থানে বিজিবি জওয়ানদের উপস্থিতিতে সেটলাররা মারধর করে। এতে অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হন। এছাড়া পালিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন আহত হন।
পালিয়ে গিয়ে উন্মুক্ত আকাশের নীচে রাত যাপন করতে বাধ্য হওয়ার কারণে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে নিউমোনিয়া আক্রান্ত ২ মাস বয়সী আশামনি চাকমা নামে এক শিশুকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সে গত ১০ আগস্ট মারা যায়। সে বান্দরসিং গ্রামের সুকুমনি চাকমার ছেলে। সুকুমনি নিজেও হামলায় আহত হয়েছিলেন।
বগা পাড়া গ্রামের সত্যব্রত চাকমার উদ্ধৃত্তি দিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ‘সকাল ১১ টার দিকে বটতলী, আচলং, তানাক্কাপাড়া থেকে শত শত সেটলার বাঙ্গালী হোন্ডা যোগে এবং পায়ে হেঁটে বান্দরশিং এর দিকে যেতে দেখেছি। তাদের হাতে ছিল লাঠি সোটা, দা, বল্লম, হাতুড়ি/মাস্তুল, কিরিচ (লম্বা দা)। দুপুর ১ টার দিকে সেটলাররা যখন হৈ হুল্লা করে পাহাড়িদের মারধর, গ্রামে হামলা ও বান্দশিং-এ অগ্নিসংযোগ শুরু করে; তখন আমরা বগাপাড়ার লোকজন সকলে পালিয়ে যাই। আমি কিছুটা লুকিয়ে বাড়ীর পাশে অবস্থান করি। বান্দরশিং এ অগ্নিসংযোগের পর সেটলাররা বগাপাড়ার নোয়াপাড়ায় অগ্নিসংযোগ, হামলা, ভাঙ্গচুর করার পর মূল বগাপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। তারা আমার পাশের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিলে আমি চিৎকার দিই। এরপর বাঙ্গালীরা আমার বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ না করে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। আমি দেখলাম প্রায় ২০০-৩০০ জনের অধিক সেটলার বাঙ্গালী আমাদের গ্রামে হামলা করতে আসে। তাদের পিছনে ছিল বিজিবি ১০-১২ জন সদস্য। যুবকরা সামনে, তারপর বয়স্করা, পেছনে বিজিবি সদস্যরা এভাবে তারা হামলা করতে আসে।’
ঘটনার আগের ঘটনা উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, হামলার কয়েক দিন আগে গত ২৯ জুলাই রাত আনুমানিক ১১টার দিকে মুখোশ পড়া ৫-৬ জন লোক সাহেব সরদারপাড়ায় ওসমান ড্রাইভার নামের এক বাঙালিকে মারধর করেছে এই অভিযোগে পরদিন বাঙালী ছাত্র পরিষদ সাম্প্রদায়িক ও উষ্কানীমূলক শ্লোগান দিয়ে তাইন্দং বাজারে মিছিল করে।
যে ঘটনাকে ইস্যু করে সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়েছে সেই হোন্ডা চালক কামাল হোসেনের অপহরণ ঘটনাকে সাজানো নাটক উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এই নাটকের সাথে তথা ষড়যন্ত্রের সাথে বিজিবির কী ধরনের সম্পর্ক তা অনুসন্ধানের বিষয়। কারণ ঘটনার দিন পাহড়িদেরকে ক্রসিং-এ ডেকে এনে মারধর করার সময় বিজিবির সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে, সেটলারদের নিবৃত্ত করতে তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি। মারধরের পর শত শত সেটলার তাদের সামনে থেকে পাহাড়িদের গ্রামে হামলা করতে যাওয়ার সময়ও তারা কোন বাধা দেয়নি। এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী বিজিবি’র সদস্যরা হামলার সময় সারাক্ষণ সেটলারদের সাথে ছিল। বিজিবির এই ভূমিকা মূল ষড়যন্ত্রের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতাকেই ইঙ্গিত করে। এছাড়া বিজিবি’র বিরুদ্ধে তাইন্দংসহ মাটিরাঙ্গার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়িদের উপর নির্যাতন, হয়রানি, বিনা কারণে গ্রেফতার, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ বানচাল ও সাম্প্রদায়িক হামলায় সেটলারদের সহযোগিতা করার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
ত্রাণ ও সাহায্যের অপর্যাপ্ততার কথা উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সরকার ও বিজিবির দেয়া ক্ষতিপূরণ ও জানমালের নিরাপত্তার আশ্বাসের পর পালিয়ে যাওয়া পাহাড়িরা বর্তমানে নিজ গ্রামে ফিরে এসেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের পুনর্বাসনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনকি জরুরী চিকিৎসারও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ত্রাণ হিসেবে যা দেয়া হয়েছে তা বিশাল মরুভূমিতে কয়েক বিন্দু পানি ফোঁটার মতো।
সরকারী প্রতিনিধি হিসেবে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকার, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহেদুল আলম, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সমীর দত্ত চাকমা সহ অনেকে ভারতের সীমান্তে আশ্রয় নেয়া পাহাড়িদের নানা প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে আনেন। এরপর থেকে তাদের কোন দেখা মেলেনি এবং তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের সাথে তারা চরম প্রতারণা করেছেন বলেও প্রেস ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করা হয়।
উল্লেখ্য, গত ৩ আগস্ট হোন্ডা চালক কামাল হোসেন(৩০) অপহৃত হয়েছেন এমন গুজব রটিয়ে পরিকল্পিতভাবে সেটলাররা মাটিরাঙ্গার তাইন্দং ও তবলছড়ি ইউনিয়নে পাহাড়িদের গ্রামে হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালায়।
এ হামলায় ১১টি পাহাড়ি গ্রামের ৮৮৩ পরিবার পাহাড়ি বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তার মধ্যে ৪৫৫ পরিবার পাহাড়ি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নোম্যান্স ল্যান্ডে এবং ৪২৮ পরিবার পানছড়ি উপজেলায় এবং আশে-পাশের বনে-জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার ও প্রশাসনের নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে পালিয়ে যাওয়া পরিবারগুলো নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসলেও পর্যান্ত ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে বর্তমানে তারা অনাহারে অর্ধাহারে ও রোগে-শোকে খোলা আকাশের নীচে দিন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।